“গণপিটুনি” মানবজাতির আদিম অভ্যাস ? বিশ্লেষণে খবরওয়ালা টিভি

৪০সেকেন্ডের একটি ভিডিও। একদল উন্মত্ত জনতা হাতে লাঠি, বাঁশ ইত্যাদি। চোখেমুখে হায়নার হিংস্রতা। চকচক করছে চোখ। অপরদিকে মুন্ডিত মস্তক, কাঁধে ঝোলা, পরনে গেরুয়া একজন সাধু। বারবার হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইছেন। আহত রক্তাক্ত দেহ। অতঃপর পুলিশের সামনেই চলল বেদম মারধর যতক্ষণ তিনি শ্বাস নিয়েছেন । তারপর মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে বুঝে ফাঁকা হয়ে গেল ভিড়। চোখমুখ নির্বিকার। যেন একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তারা ঘটাননি। সবটাই যেন সেলুলয়েডে দেখলেন।অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় ২জন সাধু সহ প্রাণ হারিয়েছেন মোট ৩জন। এই নৃশংসতা আলোড়ন ফেলেছে নাগরিক সমাজে। শিউরে উঠছে গোটা দেশ। প্রশ্ন উঠছে কেন এই হিংসা। স্রেফ গুজবে ভর করে এই যে গণপিটুনি, মানুষকে মেরে ফেলা এবং সর্বপরি আইন হাতে তুলে নেওয়ার এই যে প্রবণতা কবে বন্ধ হবে। আর কত রক্ত ঝরলে তবে ফিরবে হুঁশ। কত হাত আর রক্তাক্ত হবে।কয়েকবছর পিছিয়ে গেলে দেখা যায় ভারতবর্ষে এই গণপিটুনির ঘটনা ক্রমবর্ধমান। শুধু ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এই ঘটনা বেড়েছে প্রায় কয়েকগুণ। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। পরিসংখ্যান বলছে ২০১৯সালে সারাদেশে গণপিটুনিতে নথিভুক্ত ঘটনা ৪৬টি। কখনও গরু চোর সন্দেহে, কখনও ডাইনি সন্দেহে, কিডনি চোর, শিশু চুরি বা কখনও স্রেফ গুজব।এই প্রবণতা মারাত্মক বলছেন মনস্তাত্ত্বিকরা। বারবার প্রশাসনিক তরফ থেকে বলার পরও কেন এই ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে? ঠিক কি মনস্তত্ত্ব কাজ করে?চলুন ফিরে যাওয়া যাক আদিম যুগে। বর্তমান আধুনিক মানুষের ঠিক আগের পর্যায়। পৃথিবীতে তখন নিয়ান্ডারথালদের যুগ। হিংস্র এবং অসম্ভব বুদ্ধিসম্পন্ন আদিম মানুষ। নিজেদের পেট ভরাতে এরা নিজস্ব প্রজাতিভুক্ত জীবদের ভক্ষণ করত। আরও সহজ করে বললে এরা ছিল মানুষখেকো। এদের হিংস্রতার আরও উদাহরণ হল, শিকারের জন্য বা স্রেফ বিনোদনের জন্য এরা সমবেতভাবে লাঠি সোটা দিয়ে পিটিয়ে মারতো জন্তুদের।কালের নিয়মে এই প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে এসেছে আধুনিক মানুষ। কিন্তু কিছু কিছু জিন রয়ে গেছে আমাদের মধ্যেও। এই হিংস্রতা, উন্মতভাবে পিটিয়ে মারা এই জিনেরই বহিঃ প্রকাশ যা আমরা অবচেতন মনে যুগ যুগ ধরেই বয়ে আনছি।এ তো গেল মনস্তাত্ত্বিক দিকটা। এর পেছনে যেমন গভীর মনস্তত্ত্ব দায়ী ঠিক তেমনি দায়ী সমাজতত্ত্ব। আমাদের সমাজ, পারিপার্শ্বিক,শিক্ষা, সংস্কার সব। সমাজতত্ত্বিকরা বলছেন ভারতের মত দেশে মানুষ এখনও শোনা কথায় বিশ্বাস করে। আর তাই গুজব এদেশে দাবানলের থেকেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।ক্রাউড সাইকোলজি বলছে এই যে পিটিয়ে মারা বা গণপিটুনিতে উৎসাহ সহকারে অংশ নেওয়া এগুলোর মধ্যে একটা হিরোগিরি বা দাদাগিরির মত চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। এখান থেকেই জন্ম নেয় আইন হাতে তুলে নেওয়ার ব্যাপারটা। সাধারণ গুজব বা চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারার ক্ষেত্রে যে মনস্তত্ত্ব, শিশু চুরি বা কিডনি চুরির ক্ষেত্রে আবার ব্যাপারটা একটু আলাদা। সেক্ষেত্রে কাজ করে ভয়, আতঙ্ক। এই ভয় মানুষকে করে তোলে হিংস্র। নিজের চেনা মানুষের বাইরে কাউকে দেখলে, বা কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই সে তখন অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এক্ষেত্রে আরও একটি ব্যাপার বলতেই হয়, বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় গণপিটুনিতে লিপ্ত মানুষগুলি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। নিতান্তই নিরীহ। তবু উৎসাহভরে গণপিটুনিতে অংশ নিল। কেন ঘটল এমনটা? বিজ্ঞানীরা বলছেন এরকম বহু মানুষ আছেন যারা ভাবেন সবাই মারছে আমিই বা বাদ যাই কেন, ভিড়ের মধ্যে আমায় কেউ খুঁজে পাবেনা! সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে চোখ রাখলে দেখা যায় প্রাথমিক ভাবে মানুষ ভাবে পুলিশের কাছে গেলে সাহায্য পাওয়া যাবেনা, তার থেকে নিজেরাই বিচার করব। এর পেছনে একটি গণ হিস্টিরিয়াও কাজ করে বৈকি।আর এই হিস্টিরিয়া এখন সমাজের সব স্তরে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মোবাইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ছবি ভিডিও তোলা হচ্ছে গণপিটুনির। অর্থাৎ অন্যকে কষ্ট পেতে দেখে তার প্রতিবাদ না করে ঘটনা থেকে বিনোদনের রসদ খুঁজে নেওয়া। এবং ভিডিওগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যেমে আরও বহু মানুষকে পরোক্ষে উদ্বুদ্ধ করা। এই অসুখ মানুষের মননের গভীর থেকে গভীরে ছড়িয়ে পড়ছে। চিন্তাশীল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতে এই প্রবণতা আরও ভয়ানক হতে পারে এই গণহিংসা যদিনা তা অঙ্কুরেই বিনাশ করা হয়।

এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। এগিয়ে আসতে হবে প্রশাসনকেও। কোনও ভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবেনা এই বোধ জাগাতে হবে মানুষের মধ্যে। নাহলে আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে সমাজ। হয়ত ফিরে যাবে সেই আদিম হিংস্র যুগে।

২৩/০৪/২০২০
রিপোর্ট – স্বাতী সেনাপতি
চিত্র সূত্র – গুগল