রবীন্দ্র সমসাময়িক কবিদের মধ্যে সবাই রাবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন না কেউ কেউ রবীন্দ্র বিরোধী ছিলেন। রবীন্দ্র অনুরাগী কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, ও যতীন্দ্রমোহন বাগচী। কিভাবে তাঁদের সঙ্গে আলাপ কবির, কেমন ছিল তাদের সাথে কবির সম্পর্ক ?
রবীন্দ্রনাথের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী তে ফিরে দেখা কবির জীবনের এক অন্যজীবন।
রবীন্দ্রনাথের আদরের ভাগ্নি সরলাদেবীর মধ্যস্থতায় প্রথম অতুলপ্রসাদ এর সঙ্গে কবির আলাপ হয় খামখেয়ালি এর আড্ডায় ১৮৯৬ সালে। সেই আড্ডা থেকে অতুল প্রসাদ এবং কবির বন্ধুত্ব। এই আসর অতুল প্রসাদ সেন এর বাড়ীতেও বসেছিল। এর কিছু দিন পর অতুল প্রসাদ বিলাতে ও পরে উত্তরপ্রদেশ এ চলে যান। ১৯১৩ তে কবি নোবেল পুরস্কার পান সে আনন্দে অতুল প্রসাদ লেখেন,
” বাজিয়ে রবি তোমার বীনে,/আনলো মালা জগৎ জিনে।/তোমার চরণ তীর্থে আজি,/ জগৎ করে যাওয়া আসা।” অনুজ, স্নেহধন্য অতুল প্রসাদ’কে কবি আমন্ত্রণ জানান রামগড়ে, তার আগমনে জমজমাট ছিল কবির রামগড় ভ্রমণের দিন । কবি রোজ একটি নতুন গান লিখতেন। রোজ অতুল প্রসাদ একটি করে গান শোনাতেন।
১৯২৩ সালে মার্চ মাসে ‘আশা-আকাঙ্খা’র উদ্বোধন এ আসেন রবীন্দ্রনাথ। ভিড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অতুলপ্রসাদকে তিনি বলেন, “অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না “, কবির ডাকে তিনি গান, উদ্বোধনী গান।
রবীন্দ্রনাথও তাঁর লক্ষনৌ এর বাড়িতে যাওয়ার পথে তাঁকে কৃষ্ণকলি কবিতাটি পাঠ করে শোনান। অতুল প্রসাদ সেন এঁর গানে মুগ্ধ হয়ে কবি লিখেছিলেন ” তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী” গানটি।
১৯২৫ এ রবীন্দ্রনাথ এঁর আমন্ত্রণে অতুলপ্রসাদ আসেন শান্তিনিকেতনে , তার কিছু মাস পর কবি আবার লাখনৌ আসেন, শেষবারের মতো দেখা হয় দুই বন্ধুর , অতুল প্রসাদ এঁর মৃত্যুর পর কবি লেখেন “আমারো যাবার কাল হল শেষে আজি/হবে হবে দেখা মনে উঠে বাজি।/সেখানেও হাসি মুখে/বাহু মেলি লব বুকে/ নবজ্যোতি দীপ্ত অনুরাগে/সেই ছবি মনে মনে জাগে।

আমাদের অতি পরিচিত ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ এর প্রতিষ্ঠার দিন এই সভার অন্যতম সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানেই তার সাথে আলাপ হয় রজনীকান্ত সেন এর। সভায় তার গান শুনে মুগ্ধ কবি তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান রজনীকান্ত কে। পরের দিন তার জোরাসাঁকো এর বাড়িতে আসেন কান্তকবি। অভয়া কাব্য গ্রন্থের “সৃষ্টির বিশালতা” ও “সৃষ্টির সুক্ষতা” গান দুটো শুনে মুগ্ধ কবি বলেন “বহি: জগৎ সম্মন্ধে বেশ হয়েছে, এবার অন্ত জগৎ আর একটা করুন” ।
এর কিছুদিন পর কান্ত কবি ক্যান্সার আক্রান্ত হন। কবি তখন শান্তিনিকেতনে । কলকাতা ফিরে এসে দেখতে আসেন কান্ত কবিকে। কান্ত কবির ঈশ্বর চেতনা, তার গান ও নাটক রবীন্দ্রনাথ কে তার গুণগ্রাহী করে তুলেছিল, তিনি চেয়েছিলেন রজনীকান্তের পুত্ৰ কে শান্তিনিকেতন এ পড়াবেন, কিন্তু তার আগেই কান্ত কবি মারা যান।
১৯০১ সালের জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে বঙ্গ-দর্শন পত্রিকার সুবাদে কবিগুরুর সাথে পরিচিত হন যতীন্দ্রমোহন বাগচী। বয়সে ছোট যতীন্দ্র কবির কিছু লেখা ‘নিউ ইন্ডিয়া’ পত্রিকাতে অনুবাদ করে পাঠান। মানসী পত্রিকাতে তখন রবীন্দ্র বিরোধিতা তীব্র ভাবে চলছে, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এর সঙ্গে বিতর্কেও বিরোধে অংশ গ্রহন করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ এঁর পঞ্চাশতম জন্মদিন পালনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। যতীন্দ্রমোহন এঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ ছিল কবির খুব প্রিয়। ‘নীহারিকা’ কাব্যগ্রন্থ পরে কবি লিখেছিলেন “তোমার নীহারিকা পরে খুশি হয়েছি।…তোমার কাব্যগ্রন্থের নাম ‘নীহারিকা’।কেন দিয়েছো? ঝাপসা তো কিছুই দেখছি না। মৃত্যুর কিছু দিন আগে রবীন্দ্র নাথ যতীন্দ্রমোহনকে লেখেন “একটা কথা মনে রেখো , নতুনের ভিড়ের মধ্যে পুরাতন মাঝে মাঝে অলক্ষ হয়ে আসে, এটা অনিবার্য । যতীন্দ্রমোহন সবচেয়ে বেশি যাকে মানতেন সেই রবীন্দ্রনাথ তাকেও নিজের বহু কবিতা তাকে উৎসর্গ করেছেন ।
লেখা: সাগ্নিক সেনাপতি