মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভর করে দুই বাংলার ডিজিটাল দুনিয়া মাতাচ্ছে ওয়েবসিরিজ ‘একাত্তর’।

“তুমি বঙ্গবন্ধুর রক্তে আগুন জ্বালা জ্বালাময়ী সে ভাষণ, তুমি ধানের শীষে মিশে থাকা শহীদ জিয়ার স্বপন, তুমি ছেলেহারা মা জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি, তুমি জসিম উদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ, মুঠো মুঠো সোনার ধুলি।”

যে একাত্তরের বাংলায় লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে সার্বভৌম বাংলাদেশ, পূর্ব পাকিস্তানের খোলস ত্যাগ করে স্বাধীন বাংলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেই রক্তঝরানো ইতিহাস, সেই আত্মত্যাগের ইতিহাস, সেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আজীবন আমাদের হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করবে। দেশের গৌরবময় বিজয়ের দলিল তাই বারে বারে ফিরে আসতে চায়, শিল্পে, চলচ্চিত্রে তথা আপামোর সংস্কৃতিতে। চলচ্চিত্রের কোন দেশ হয়না, সে ভাষা বরাবরই আন্তর্জাতিক। তাই সমস্ত মানচিত্রের বেড়াজাল ডিঙিয়ে, তামিম নুরের পরিচালনায় নির্মিত “একাত্তর” নামক ওয়েব সিরিজটি বর্তমানে “হইচই অরিজিনাল”- এ দেখা যাচ্ছে।

৮ টি পর্বে নির্মিত ওয়েব সিরিজটির গল্প ছোট করে বলতে গেলে,একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। ঢাকা শহরে তখন দিনভর কার্ফু লেগে আছে,তার মধ্যেই এক আলতো প্রেমের কুঁড়ি অল্প অল্প করে মাথা চারা দিয়ে জাগছে। সেলিম ভাই(মুস্তাফা মনোয়ার) আর জয়িতার(তিশা) প্রেম। জয়িতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, বুদ্ধিমতী, রুচিশীল তরুণী, দেশের বিক্ষুপ্ত রাজনৈতিক পরস্থিতি নিয়ে যে যুক্তিপূর্ণ তর্কে সামিল হতে পারে, প্রয়োজনে দেশের জন্য হাতে অস্ত্র ও তুলে নিতে পারে। অন্যদিকে সেমিল ভাই পাড়ার এক নামকরা গুন্ডা। গাড়ির গ্যারেজের আড়ালে তার দল অস্ত্র মজুত করে, পাড়ার অন্য দলের সাথে যাদের গ্যাংওয়ার লেগেই থাকে। জয়িতার সাথে তার রুচিগত পার্থক্য বিস্তর, তবুও ভালোবাসার এক সূক্ষ তিরতিরে নদী যেন কোথাও বইতে থাকে, টেমিগান মজুত করা সেলিমভাই ও জীবনানন্দের কবিতার বই তুলে দেয় জয়িতার হাতে।


গল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে আছে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা সামরিক বাহিনীর জঘন্য ষড়যন্ত্রের ইতিবৃতান্ত।পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের ওপর অকথ্য অত্যাচার, নির্বিচার সাজানো, সেই সাথে ‘অপারেশন ব্লিটজ’ নাম দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা। ক্যাপ্টেন সিরাজ নামের (মোস্তাফিজুর নূর ইমরান) এক বাঙালি অফিসার গোপনে সেই ষড়যন্ত্রের ফাইল জোগাড় করে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই মেজর ওয়াসিম (ইরেশ যাকের) তাকে নিকেশ করে দেয়। এই উত্তাল সময়ে বাংলাদেশে কর্মরত এক সাংবাদিক রূহির ভূমিকায় অভিনয় করেন (মিথিলা)।মুখ্যত থ্রিলারের ধাঁচেই টানটান উত্তেজনার বাতাবরণ রেখেই শেষ হয় একাত্তরের ৮ টি এপিসোড।

ছবিতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে থ্রিলারের মোড়কে নিখাদ প্রেমের গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে ছবির আদর্শগত দিকগুলোয় উঁকি দিলে বেশ কিছু গভীর সমীকরণ উঠে আসে। রূহি আর ওয়াসিমের সম্পর্কটা তার প্রমাণ। দুজনেই দুজনের পেশাগত দায়বদ্ধতায় অটল থাকতে চায়, আর মাঝখান থেকে শেষ হয়ে যায়, তাদের দুজনের মধ্যেকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক।রূহি সরাসরি তার মেজর স্বামী কে প্রশ্ন করে- “ইস্ট পাকিস্তান মে কেয়া করনা হ্যায়, অর এক বালুচিস্তান বানানে হ্যায়” উল্টোদিক থেকে প্রত্যুত্তর আসে “ ম্যা স্রেফ এক সিপাহী হু”।রূহিও সাংবাদিক হিসাবে তার কাজ থামায় না, আর তার স্বামীও সেনাবাহিনীর নির্দেশ মেনে ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। মাঝখান থেকে আদর্শগত দায়বদ্ধতা হাহাকার করে। আরেক যুগল সেলিম ভাই আর জয়িতার কথায় আসা যাক, রুচিগত ব্যবধান তাদের মধ্যে অন্তরায় ছিল ঠিকই, কিন্তু বিনা নোটিশে রাতারাতি বদলে যাওয়া জয়িতাদের পরিবারের পাশে যে অবলম্বন হয়ে সেলিম ভাই দাঁড়িয়েছিল,সেখানে রুচিগত, শ্রেণীগত ব্যবধান তুচ্ছ হয়ে যায়, মানবিক উদারতাই প্রকট হয়ে ওঠে। এই গল্পতেও তার অন্যথা হয়নি।


কারিগরী দিকের কথা বলতে গেলে বেশ কিছু গলদ প্রথমেই চোখ আটকায়, একাত্তর সালের গল্প হলেও সেট ডিজাইনিং সেই কথা বলেনা, শুধুমাত্র কস্টিউম দিয়ে খুব বেশী সময়ের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব নয়। এমনকি লাইট এর সেটিং খুবই শিশুসুলভ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কে বিষয় করে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও ছবিতে রাজনীতি এসেছে প্রায় নগণ্য মাত্রায়,মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের যে বিশাল অবদান ছিল, তা প্রায় কিছুই দেখা যায়নি ছবিতে। অভিনয়ের চোস্ত ভাব দু তিনজন অভিনেতাকে বাদ দিলে বাকিদের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতাই তৈরি হয়নি।এডিটিং এর ক্ষেত্রে কালার কারেকশন নিয়ে বেশ কিছু কাজ করা যেতে পারতো, পরিচালক সেদিকে নজর দেননি।


এসবের পরেও ওয়েব সিরিজ মানেই যে অ্যাডাল্ট কন্টেন্টের দিকে ঝোঁক, এ তত্ত্বকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে একাত্তর রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে ছবি করার দুঃসাহস দেখিয়েছে, এই জন্যই তার সাধুবাদ প্রাপ্য। সেই সাথে মিহি এক প্রেমের গল্প বলে, যা মনে থেকে যায় এক সুতীব্র ভালোলাগায়।


রূপসা দাস

২৭.০৫.২০২০

কলকাতা