সব খুললেই মরে যাব? কী করবেন লকডাউনের পর? ব্রিটেন থেকে লিখলেন ড. অনির্বাণ ঘোষ

দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১ লক্ষ ৯২ হাজার পার করেছে। মৃত্যুতে চীনকে অনেকদিন আগেই ছাড়িয়েছে ভারত! কিন্তু অনেকদিন লক ডাউনে দেশ প্রায় স্তব্ধ থাকার পর, আবার শুরু হয়েছে ধাপে ধাপে স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া! ‘আনলকে’র প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে আজ থেকেই! এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আশঙ্কিত অনেকেই! কী হবে এবার? করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হবে? ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে ফের? ভারতের অবস্থা করুণ হবে? কী হবে আমাদের? এইরকম হাজারো প্রশ্ন মানুষের মধ্যে! সেই বিষয়ে আপনার মনের ১৫ টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘হায়রোগ্লিফের দেশে’র রচয়িতা এবং ব্রিটেনের বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক অনির্বাণ ঘোষ।


প্রশ্ন ১- লকডাউন উঠে গেল। আমাকে বাইরে বেরোতেই হবে। আমি তো মারা যাব এবারে। কী হবে আমার?

চিকিৎসক: কী হবে সেটা বলার আগে দেখে নিই অন্যান্য জীবানু ঘটিত রোগে দেশে কত মানুষ মারা যান।

*রেবিসে ১০০%
*জাপানিজ এনসেফালাইটিসে ১১%
*টিবিতে ৪.২%
*মেনিনজাইটিসে ৪%

এছাড়া প্রতিদিন-

হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছেন ৪২২০ জন।
স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন ১০২৫ জন।
হাঁপানির রোগে মারা যাচ্ছেন ২,৬২৬ জন।
অ্যাজমায় মারা যাচ্ছেন ৬৯৮ জন।
অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাচ্ছেন ৬৭০ জন।

এবারে দেখি দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে কত শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছেন-

আজকে এই লেখার সময় ১ লক্ষ ৯০ হাজার ৫৩৫ জন বেশি আক্রান্তের মধ্যে মারা গিয়েছেন ৫ হাজার ৩৯৪ জন। অর্থাৎ মোট শতকরা হিসেবে ২.৮৩ শতাংশ।

একটা ব্যাপার আমাদের বুঝতেই হবে যে ‘স্ট্যাটিস্টিক্স’ কখনও মিথ্যে কথা বলে না। শুকনো অঙ্কের মতো সত্যি আরকিছু নেই। যদি ধরেও নিই যে রাষ্ট্র যে সংখ্যা দিচ্ছে তা ভুল, তাহলেও কোভিড-১৯ -এ মৃত্যুর হার ৪ শতাংশের বেশি নয় এখন।

অর্থাৎ ধরে নিই প্রতি ১০০ জনে ৪ জন মারা যাচ্ছেন। কোভিড-১৯ -এ মোট মৃত্যুর মধ্যে
*৪৯% এর বয়স ৭৫ বছরের এর ওপরে।
*২৫% এর বয়স ৬৫ থেকে ৭৪ বছরের মধ্যে।

আর এই লকডাউন উঠে যাওয়ার দরুণ মূলত যাদেরকে অর্থ উপার্জনের জন্য রাস্তায় বেরোতে হবে তাদের বয়স কেমন?

১৮ থেকে ৬৪ র মধ্যে। এঁদের মধ্যে মৃত্যুর হার কত?

আমি অঙ্কটা আপনাদের জন্য কষে দিচ্ছি-

আপনার বয়স যদি ১৮-৪৪ বছর এর মধ্যে হয় তাহলে- অর্থাৎ ১০০০ জনে ১ জন।

আপনার বয়স যদি ৪৫-৬৪ বছর এর মধ্যে হয় তাহলে-

১০০ জনে ১ জন।

এবারে নিজেই ভাবুন। অন্যান্য রোগের তুলনায় কোভিড-১৯ -এ আপনার মৃত্যুর আশঙ্কা কতটা? টিবি, মেনিঞ্জাইটিসে যতটা ঠিক ততটাই। আপনি কি এই দুটো রোগে মৃত্যুর ভয়ে একই রকম ভীত? বাইরে বেরোবেন না এর ভয়ে?


প্রশ্ন ২- কিন্তু আপনার বলা বাকি রোগের চিকিৎসা আছে। কোভিডের কোন চিকিৎসা নেই শুনলাম!

চিকিৎসক: ভুল শুনেছেন। কোভিডের প্রাথমিক চিকিৎসা আর পাঁচটা ভাইরাল ডিজিজ এর মতোই। কী সেটা-

*জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল।
*প্রচুর জল খাওয়া।
*যতটা সম্ভব বিছানায় শুয়ে রেস্ট নেওয়া।

এতেই বেশির ভাগ মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছেন। আজ অবধি আমাদের দেশে ২৬ লক্ষ ৪১ হাজার ৩২৯ জন মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেছেন এইভাবেই।

এবারে কোভিড-১৯ এর কমপ্লিকেশনের জন্য যে চিকিৎসা তার জন্য ওষুধ খোঁজা চলছে এখনও। ‘রেমডেসেভির’ নামের একটি ওষুধে সামান্য ভাল কাজ হচ্ছে। কিন্তু তা ভীষণই খরচা সাপেক্ষ। ভারতবর্ষের মতো দেশে এর ব্যবহার খুব বেশি হবে না।


প্রশ্ন ৩- শুনেছিলাম যে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ভাল কাজ দেয় কোভিডে? আমি যে দোকান থেকে কিনে খেলাম?

চিকিৎসক: ভুল জানতেন। ‘ল্যান্সেট’ হল পৃথিবী বিখ্যাত একটি সায়েন্টিফিক জার্নাল। তাতে বেরোনো একটি পেপারে প্রমান হয়ে গিয়েছে যে, এই ওষুধ অর্থাৎ হাইড্রক্সিক্লোরোক্যুইন কোভিডের চিকিৎসায় কোন কাজেই আসে না। উল্টে এতে হৃদপিন্ডের রোগে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে।


প্রশ্ন ৪- আচ্ছা, কিন্তু আরোগ্য সেতু অ্যাপে আমার বাড়ির ৩০০ মিটারের মধ্যে একজন কোভিডের রূগী আছে দেখলাম। আমার পাশের পাড়া থেকেই একজন কোভিড রুগীকে ধরে নিয়ে গেল। ভয় লাগছে, কী হবে আমার?

চিকিৎসক: এভাবে রুগী গোনা ছেড়ে দিন। আপাতত সামনের এক বছরের জন্য করোনা ভাইরাস এই পৃথিবীরই একটা অংশ এটাই ভেবে নিন। একটা সময় এমনও আসতে পারে যখন হয়ত প্রতিটি পরিবারেরই কারোর না কারোর কোভিড-১৯ হবে। সুতরাং এইভাবে চেরি পিকিং করে কোন লাভ নেই।


প্রশ্ন ৫- আপনি বলছেন বাইরে বেরোন। তাহলে এই দু’মাসে লকডাউন করে লাভটা কী হল? আক্রান্তের সংখ্যা তো রোজ বেড়েই চলল? আগে বেরোলেই তো হত তাহলে?

চিকিৎসক: লকডাউনের পরেও সংখ্যা যে বেড়েই চলল তার দুটো কারণ আছে-

প্রথমটি হল, দেশের সাধারণ মানুষের খুব সহজ একটা নিয়মকে মেনে চলার অক্ষমতা। বারবার বলা সত্ত্বেও ভাল মন্দ খাওয়ার লোভে বা পাড়ায় আড্ডা মারার লোভে বারবার বাড়ির বাইরে বেরোনো। সামাজিক দায়িত্ববোধের যে কতটা অভাব আমাদের মধ্যে সেটা আরেকবার প্রমাণ হয়ে গেল।

দ্বিতীয় কারণটি হল, এই যে লকডাউনের পর থেকে দেশ জুড়ে টেস্টিং বা পরীক্ষার সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। তাই আক্রান্তদের বেশি মাত্রায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।


প্রশ্ন ৬- অফিস খুলেই যাচ্ছে। বেরোতেই হবে এবারে। বাসে, ট্রামে, ট্যাক্সিতে উঠতেও হবে। সেখানে সোসাল ডিস্ট্যান্সিং কী ভাবে মেন্টেন করব?

চিকিৎসক: করাটা একেবারেই সম্ভব নয়। আপনাদেরকেই যতটা সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সেগুলো হল-

*বাইরে বেরোলে মাস্ক পরে থাকা। মাস্ক পরে থাকা অবস্থায় একবারের জন্যও মুখে,চোখে,কানে হাত না দেওয়া। যে কোন মাস্ক পরলেই হল। N95 পরতে হবে এমন কোন ব্যাপার নেই।

*প্রয়োজন ছাড়া কোন বস্তুতে হাত না দেওয়া।

*যদি সম্ভব হয় তাহলে হাতে ডিসপোজেবল গ্লাভস ব্যবহার করা। ডিজপোজেবল গ্লাভস একবারই ব্যবহার করার জন্য।

*গ্লাভস না পেলে দুঘন্টা অন্তর সাবান জলে কনুই অবধি হাত ধোয়া।

*রাস্তায় থাকলে ঘন্টায় একবার স্যানিটাইজার দিয়ে হাত মুছে নেওয়া।

*বাড়ি ফিরেই সোজা বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে চান করে ফেলা। সাথে নিজের পরণের জামাটাও রোজ কেচে ফেলা।

*যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে চলুন। অযথা হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলির কোন দরকার নেই।


প্রশ্ন ৭- আমার ডায়াবেটিস/অ্যাজমা/হার্টের রোগ আছে। কী করব?

চিকিৎসক: আপনাদেরকে আরো সাবধান হতে হবে। আগের প্রশ্নে বলে দেওয়া পয়েন্টগুলোকে আরো ভালভাবে মেনে চলতে হবে।

ডায়াবেটিক রুগীরা নিজেদের সুগারকে কন্ট্রোলে রাখুন। বাড়িতে গ্লুকোমিটার কিনে মাঝে মাঝেই সুগার মাপুন। ডাক্তারের কথা মেনে চলুন।


প্রশ্ন ৮- কোভিডকে আটকানোর কোন উপায় আছে?

চিকিৎসক: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবেন এইভাবে-

*সিগারেট একেবারে বন্ধ।

*মদ একেবারে বন্ধ।

(জানি এই দুটো মানতেই নাভিশ্বাস উঠে যাবে আপনাদের। কিন্তু এই দুটো চালিয়ে গেলে আপনার আর কোন রোগ না থাকলেও কোভিডে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেকটা বেশি।)

*পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম।

*সবুজ শাক, সব্জী,ফল খাওয়া।

*লেবুতে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। রোজ খেতে পারলে খুব ভাল।

*ওপরের দুটো পয়েন্ট না মানতে পারলে রোজ একটা করে ভিটামিন সি ট্যাবলেট আর মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট খাওয়া।

*সারা দিনে অনেকটা জল খাওয়া।


প্রশ্ন ৯- বাড়িতে বয়স্ক মানুষ, রোগে ভুগছেন। তাদের জন্য কী করব?

চিকিৎসক: তাঁদেরকে ভীষণ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বার করবেন না।

*৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলে দেওয়া কথাগুলোকে মেনে চলবেন। তাহলে আপনি বাইরে থেকে রোগটাকে বয়ে নিয়ে আসবেন না আর।


প্রশ্ন ১০- আচ্ছা ভ্যাকসিনের কী হল?

চিকিৎসক: ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে ভীষণই আশাপ্রদ ফল পাওয়া গেছে। এই বছরের শেষ থেকে ভ্যাকসিন সাধারণ মানুষের জন্য পাওয়া যেতে পারে।


প্রশ্ন ১১- বাচ্চাদের জন্য কী করণীয়?

চিকিৎসক: বাচ্চাদের মধ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়া বা মৃত্যুর হার ভীষণ ভীষণ কম। কিন্তু ওরা তো ভালভাবে সব নিয়ম মানতে পারবে না তাই বাইরে থেকে রোগটাকে বয়ে বাড়িতে আনতে পারে, তাই-

খুব দরকার না হলে বাড়িতে রেখেই পড়াশোনা করান।

জুলাই এর শেষ থেকে শুনেছি ক্লাস ৮ এর বাচ্চারা স্কুলে যাবে। তারা যথেষ্টই বড়। তাদের জন্য ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তর ফলো করুন। রোজ একটা ভিটামিন ট্যাবলেট খাওয়াতে পারেন।


প্রশ্ন ১২- জ্বর,সর্দি হলে কী করব?

চিকিৎসক: আমাদের রাজ্যের আবহাওয়ার জ্বর, সর্দি,কাশি লেগেই থাকে। তাই এগুলো হওয়া মানেই কোভিড হওয়া নয়। এই লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিন আপনার সিম্পটম কোভিডের সাথে মিলছে কি না-

https://www.nhs.uk/conditions/coronavirus-covid-19/check-if-you-have-coronavirus-symptoms/


প্রশ্ন ১৩- শুনেছি অনেক কোভিড-১৯ রুগী নাকি আসিম্পটম্যাটিক! তাহলে কী হবে!?

চিকিৎসক: ঠিকই শুনেছেন। তার জন্যই বাইরে বেরোলে সর্বক্ষণের জন্য সাবধানতা নেওয়ার কথা বলছি। আবার ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দেখুন।


প্রশ্ন ১৪- বাইরে থেকে আনা জিনিসপত্রে ভাইরাস থাকবে? কী করব?

চিকিৎসক: হ্যাঁ, থাকতে পারে।কার্ডবোর্ডে ২৪ ঘন্টা।তামার জিনিসে ৪ ঘন্টা।প্লাস্টিকে আর স্টেইনলেস স্টিলে ২-৩ দিন।

তাই বাড়ির বাইরে থেকে আসা জিনিসপত্রের সারফেস গরম জলে বা সারফেস ক্লিনার দিয়ে মুছে নিন। যে কোন রকমের সারফেস ক্লিনার হলেই চলবে।

বাইরে থেকে কিনে আনা শাক সব্জী, মাংস ভাল করে গরম জলে ধুয়ে নিন। কাজটা খাটনির। কিন্তু করতে হবে।

ধোয়া মোছার পরে অবশ্যই নিজের হাতও সাবান জলে ধুয়ে নেবেন।


প্রশ্ন ১৫- সব খুলে গেল, সব শেষ হয়ে যাবে, হায় হায়, চারদিকে অন্ধকার…!

চিকিৎসক: না, একেবারেই না। তবে সামনের বেশ কয়েকটা মাস এইভাবে চলতে হবে।


লেখা: চিকিৎসক অনির্বাণ ঘোষ, লিউটন অ্যান্ড ডান্সস্টেবল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল, ব্রিটেন।