১৯৭০’এ কলকাতার প্রিয়া, বসুশ্রী সহ একাধিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত চলচ্চিত্র অরণ্যের দিনরাত্রি, মুক্তির সাথে সাথেই ছবিটি বেশ একটা আলোড়ন তৈরী করে। আলোড়নটা কেন্দ্রীভূত হয় মূলত একটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে।প্রথমেই আপত্তি আসে, লেখকের তরফ থেকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যজিৎ এর এই রূপান্তর কিংবা সংযোজনে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, সত্যজিৎ তাঁর গল্পের মেজাজটাই আমূল বদলে দিয়েছেন। পরবর্তীতে আনন্দলোক পত্রিকার সত্যজিৎ সংখ্যায় (মে,১৯৯২) স্মৃতিচারণায় সুনীল বলেছিলেন : “নির্লিপ্তভাবে এ ছবি দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি নিজে এবং আমার কয়েকজন বন্ধু এই উপন্যাসের আসল চরিত্র।” এত বিতর্ক হওয়া সত্ত্বেও অরণ্যের দিনরাত্রিকে নিঃসন্দেহে বাংলা ক্লাসিক ছবির তালিকাভুক্ত করা যায়, যদিও সে যুগে, বর্তমান সময়ের ন্যায়ে, চলচ্চিত্রের নেগেটিভ প্রমোশন, ছবির কাটতি বাড়াতো কিনা, তা যদিও হলফ করে বলা যায় না।
কাঞ্চনজঙ্ঘার পর এই ছবিতে এসে সত্যজিৎ নিটোল গল্প বলার চিরাচরিত আঙ্গিকের পরিবর্তে, টুকরো টুকরো আখ্যান নির্মাণের উপর জোর দিলেন। হালকা ছলে, লঘু মেজাজের এই ছবি অনেক বেশি আধুনিক, সমসাময়িক, অথচ বাহুল্যবর্জিত গাম্ভীর্য তার পরতে পরতে ছড়ানো। অরণ্য প্রকৃতির সাথে বিপ্রতীপ সম্পর্কযুক্ত নগর সভ্যতার যে চিরাচরিত ব্যবধান, তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, শহুরে যুবকদের নাগরিক বাবুয়ানার শৌখিন দেখনদারিতে।শহুরে দায়দায়িত্ব, পিছুটান সব ছেড়ে বহুদূরে অরণ্যের বুকে ছুটি কাটাতে এসেও শহর তাদের পিছু ছাড়ে না, বরং চেতনায়, মননে, অভ্যাসে,দৃষ্টিভঙ্গিতে, প্রতিনিয়ত প্রতিফলন ঘটায়, শহুরে সংস্কৃতি, নাগরিক ভোগবাদ। অরণ্য তাদের কাছে হয়ে ওঠে অফুরান ফূর্তির এক বিরামহীন ক্ষেত্র।
কাহিনীর গঠনতন্ত্রঃ ছবির শুরুতেই আমরা দেখি, চার বন্ধু অসীম, শেখর, হরি আর সঞ্জয়, সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ ডাইরি “পালমৌ” পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে,ছোটনাগপুরের জঙ্গলে কয়েকদিনের জন্য ছুটি কাটানোর উদ্দেশ্যে, খানিক উদ্দেশ্যহীন ভাবেই বেড়িয়ে পড়ে। যদিও চার বন্ধু মানসিকভাবে চার ভিন্ন মেরুর মানুষ। এদের মধ্যে অসীম(সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) উচ্চপদস্থ কর্মচারী, উচ্চাকাঙ্খী, তদুপরি কর্তৃত্ববাদী, সঞ্জয়(শুভেন্দু চ্যাটার্জি) দশটা-পাঁচটার প্রতিষ্ঠিত চাকুরীজীবী, যে সময়ের অবসরে মাঝেমধ্যে সাহিত্যচর্চাও করে থাকে, অন্যদিকে হরি (সমিত ভঞ্জ)সদ্য প্রেমে আঘাত পাওয়া এক সুঠাম দেহের খেলোয়াড় আর শেখর (রবি ঘোষ)সদ্যচাকুরী হারানো এক বেকার, যদিও বাকি তিনজনের তুলনায় তার রসবোধই সবথেকে বেশি। নাগরিক সভ্যতা থেকে বহুদূরে ছুটি কাটাতে এসে তারা ত্রিপাঠী পরিবারের সাথে ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পরে, আর এভাবেই টুকরো টুকরো দৃশ্যকল্পে ফুটে ওঠে তাঁদের চরিত্রের নানা খুঁটিনাটি দিক,জাগতিক ভোগবিলাস,অতৃপ্ত বাসনা, আর প্রেমের মৃদু বাতাবরণ।
শহুরে সভ্যতা থেকে যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে শেখর খবরের কাগজে আগুন ধরিয়ে প্রতীকী বিচ্ছন্নতার আভাস দেয় ঠিকই, কিন্তু বারেবারে বিভিন্ন ঘটনা , তাঁদের আচরণ ছবি থেকে কখনোই শহরকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনা। দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার যে তাদের কার্যত মজ্জাগত হয়ে উঠেছে, তার আভাস মেলে ছবির শুরুতেই, ডাল্টনগঞ্জের বাংলোয় বিনা অনুমতিতে ,চৌকিদারকে টাকার লোভ দেখিয়ে, একপ্রকার দখল করে বসে। বোস সাহেব কিংবা সুখেন্দুর কাছ থেকে সামাজিক কর্তপক্ষের ব্যতিক্রমের নজির আদায় করাটাও প্রত্যক্ষভাবে শহুরের শ্রেণী কৌলিন্যতাকে প্রকট করে তোলে, আর প্রশ্ন তুলে দেয় সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলিকে নিয়ে। যেখানে বাংলোর কর্তৃপক্ষ ত্রিপাঠি সাহেবের মেয়ে অপর্ণার(শর্মিলা ঠাকুর) কথায় গদগদ হয়ে সায় দিয়ে দেয়, এই অনৈতিক দখলদারিকে। যেখানে সত্যজিৎ এক বৃত্ত রচনা করে, যেখানে শহুরের বাবুদের আশ্রয় দেওয়ার সুবাদে চৌকিদারকে হাত পেতে ঘুষ নিয়ে তার সততার সাথে আপোষ করতে হয় আবার অসুস্থ বউকে নিয়ে, চাকরির অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হয়, শুধুমাত্র চারজন শহুরে বাবুর খামখেয়ালি বোহেমিয়ানিজমের খেসারত দিতে।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় পালামৌর সাঁওতাল মেয়েদের যে শারীরিক এবং আচরণগত বর্ণণা আছে, তা চারজন যুবককে প্রলুব্ধ করেছিল, নিঃসন্দেহে, অরণ্যের ভাঁটিখানায় হাড়িয়া খেতে খেতে দুলির (সিমি গারেওয়াল) মতো মেয়েকে একসাথে বসে হাড়িয়া খেতে দেখে, তার শারীরিক বিভঙ্গে কার্যত তাদের চোখ আটকায়। বাংলোতে কাজ করার প্রস্তাব দেবার পর যেভাবে ক্লোজ শটে শুধুমাত্র দুলির বডি এক্সপোজারের দিকে ফোকাস করা হয় তাতে, শহুরের মানুষজনের চোখে সাঁওতাল মেয়েদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা যেন ভোগ্যবস্তুর ন্যায়ে শুধুই শরীর কেন্দ্রিকতায় আবদ্ধ। সুনীলের উপন্যাসে আছে, হরি, দুলির মধ্যে এক আদিতম সরলতার খোঁজ পেয়েছিল, সত্যজিতের ছবিতে হরি, তার প্রেমিকার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এক বন্য রিরংসায় দুলির কাছ থেকে শুধুমাত্র যৌনতা কিনতে চেয়েছে, তাও অর্থের বিনিময়ে,পরিশেষে দুলির মুখে তার মৃত স্বামীর স্মৃতিচারণা, এক সুদীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসকে প্রকট করে তোলে, যা খোঁপার জাল আর সুগন্ধি দিয়ে যেই অবাধ স্বেচ্ছাচারীতাকে আড়াল করা যায়না।
অরণ্যের দিনরাত্রির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে আছে মাইন্ড গেম খেলাটি, অরণ্যের বুকে মাদলের শব্দে চলে একরাশ শব্দের মাধুকরী, এই প্রথম বাংলা ছবিতে ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে একটি বৃত্ত রচনা করে, যাতে ঘুরে ফিরে আসে, রবীন্দ্রনাথ থেকে কার্ল মার্ক্স, মাও সে তুঙ থেকে শেক্সপিয়র। এর মধ্যে মনার্কি, ফিউডালিজম এর মতো শব্দগুলো ঘুরে ফিরে আসতে থাকে।যেখানে অপর্ণা আপনা থেকেই হেরে গিয়ে অসীমের কর্তৃত্ববোধ আঘাত দিতে চায়, আর পরস্পরবিরোধী শব্দের মাঝেই অসীমের অভিব্যক্তিতে “মেল ইগোর” চাপা আঘাতবোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অরণ্য প্রকৃতির মাঝে অবদমিত কামনা বোধহয় মাথাচারা দিয়ে জেগে ওঠে, সঞ্জয় আর জয়া (কাবেরী বোস)ত্রিপাঠির মধ্যেকার সম্পর্কের সমীকরণ সেই আভাসই দেয়, বাংলোতে সেই দিনের সন্ধ্যার পরিবেশ , সালাঙ্কারা বিধবা রমণীর কামুক বিভঙ্গ, বিধবাদের অবদমিত অনুভুতির শোষণকে সামনে এনে ফেলে। বুকের কাছে হাত রেখেও কথা বলতে পারেনা সঞ্জয়। মধ্যবিত্ত সামাজিক নৈতিকতা তাকে চেপে ধরে। নৈঃশব্দতায় ঢেকে যায় চরাচর। সামাজিক বিধিনিষেধ যে শুধুমাত্র সাদায় সাদায় মুড়ে একজন বিধবাকে সারাজীবনের জন্য নির্বাসিত করে, তার অনুভূতি, কামনাকে পিষে মেরে ফেলে,জয়া ত্রিপাঠির সঞ্জয়কে কাছে পাওয়ার এই স্বতস্ফূর্ত কামনা সেই সামাজিকতার বিরুদ্ধেই একটা প্রশ্নচিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
অসীম আর অপর্ণার সম্পর্কের সমীকরণে রোম্যান্টিক বাতাবরণ ছড়িয়ে দিলেও পরিচালক তাকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাননি, বরং শহুরে, রুচিশীল প্রেমের নিতান্তই প্রতীক হিসাবে সারা ছবি জুড়ে বইতে থাকে, তাদের কথোপকথনে, বইয়ের পছন্দের নিরিখে, সমাজের শ্রেণী কৌলিন্যতার সামঞ্জস্যে।যেখানে কাগজ না থাকার দরুণ পাঁচ টাকার নোটে ঠিকানা লিখে দেবার মতো বিলাসিতা তারা করতেই পারে।
চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র শেখরকেই মেলায় জুয়া খেলার টান ব্যতীত আর অন্য কোন আনুষঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে দেখা যায় না।সেই যেন একমাত্র অরণ্যের বুকে প্রাণখুলে উপভোগ করে প্রকৃতিকে তবুও নাগরিক অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনা সেও। পারেনা জলখাবারে ডিমের অভ্যাস কিংবা দাঁড়ি কামানোর মতো অভ্যাস ত্যাগ করতে।তবুও তার কোন পিছুটান নেই ছবিতে , নেই কোন বাড়তি আত্মপ্রত্যাশা।
অরণ্যের দিনরাত্রির ঘটনাবলী হয়তো খুবই নগণ্য তা সত্ত্বেও ঘটনাগুলোকে পাথেয় করে চরিত্রদের মুখোশ খুলে ফেলার কাজটি মোটে সহজ ছিলনা, যেভাবে খুলে পরেছিল, হরির হাতের টানে তার প্রাক্তন প্রেমিকা অতসীর মাথার পরচুলা।
সত্যজিৎ নিজে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে মেরী সিটনের কাছে এক চিঠিতে বলেছিলেন,
‘ চলচ্চিত্রটির প্রথম অর্ধাংশে আছে মৃদু রসবোধের উপস্থিতি, কিন্তু আস্তে আস্তে সেটা এক অনন্য সাবলীলতায় একটা ভাবগম্ভীর পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়’।
সত্যিই তাই, নিস্তরঙ্গ এক নির্মাণের গঠনশৈলী, শাল পলাশ, মহুয়ার বনের আদি অকৃত্রিম সরলতার সঙ্গে শহরের নাগরিক সভ্যতার ভন্ডামিকে পৃথকভাবে স্পষ্ট করে তোলে, আর মাদলের সুর রচনার করে দেয় বৃত্ত সম্পূর্ণ করার এক মায়াময় আবেশ।
কলমে রূপসা দাস
চিত্র সূত্র- গুগল