হৃদয়েই তো লেখা আছে এই নাম… শুভ জন্মদিন মান্না দে (১৯১৯-২০১৩)

‘যদি কাগজে লেখ নাম, পাথরে লিখে নাম সে নাম ধুয়ে যাবে, হৃদয়ে লেখ নাম সে নাম রয়ে যাবে…’ রয়ে গিয়েছে। তাঁর নাম তো বটেই, তব্র সৃষ্টির অমোঘ আকর্ষণে, মানুষের মননে আজও স্বর্ণাক্ষরে গ্রথিত আছে তাঁর নাম। তিনি প্রবোধ চন্দ্র দে। এই নামে তাঁকে খুব কম সংখ্যক শ্রোতা চিনলেও, মান্না দে নামে চেনেন না, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া বড় গবেষণার বিষয় হতে পারে বটে! বাংলা তো বটেই, ভারতীয় সঙ্গীত, ভারতীয় সিনেমার সঙ্গীত জগতে এক অনন্য, অন্যতম নাম তিনি। আজ তাঁর জন্মদিন।

সালটা ছিল ১৯১৯। পয়লা মে’র দিন জন্ম হয় এই প্রবাদপ্রতিম স্রষ্টার। প্রবোধ চন্দ্র দে নামটি তাঁর পরিবারের দেওয়া। বাবা পূর্ণচন্দ্র দে, মা মহামায়া দেবী। তাঁদের দেওয়া নামে তাঁকে কম মানুষই চেনেন। সঙ্গীতের জগতে প্রায় ৬ দশক রাজত্ব করা মানুষটি মান্না দে অথবা মান্না বাবু বেশি নামেই পরিচিত হন যুগ-যুগান্তরে।

কলকাতায় তাঁর শিক্ষা জীবনের মূলপর্ব অতিবাহিত হয়েছে। স্কটিশ চার্চ কলিজিয়েট স্কুল থেকে প্রথমপর্বের পাঠ চুকিয়ে, ভর্তি হলেন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে। বন্ধুদের গান শোনাতেন মান্না। তাঁর মামা ছিলেন বিখ্যাত সংগীতকার। যাঁর প্রভাবেই গানের জগতে পাড়ি তখন থেকেই। একসময় ইন্টার কলেজ সঙ্গীত প্রতিযোগিতায়, পরপর তিনবছর প্রথম হন তিনি। মামা কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং ওস্তাদ দাবের খানের কাছে সঙ্গীতের তালিম নিতে থাকেন মান্না। যা একটা সময়ে গিয়ে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল বাংলা থেকে মুম্বইয়ে। যদিও বাংলা তখন মুম্বইয়ের সঙ্গীত জগৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

১৯৪২ সাল। কিশোর মান্না দে, মামার হাত ধরে পাড়ি দেব মুম্বইয়ে। তাঁর মামা অর্থাৎ কেসি দে’র সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ পান। তারপর সুযোগ আসে শচীন দেববর্মনের সঙ্গে কাজ। এবার শুরু করলেন নিজেই। সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করলেন মান্না। কিন্তু এর সঙ্গেই চলতে থাকল ওস্তাদ আমান আলী খান, ওস্তাদ আব্দুল রহমানের কাছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম। ১৯৪৩ পরের বছর প্লেব্যাক সঙ্গীত জগতে প্রবেশ। ‘তামান্না’ ছবিতে, সঙ্গীতশিল্পী সূর্যের সঙ্গে ডুয়েট। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। পরপর হিট। সাফল্য আসতে থাকে বারবার। ‘পরবরিশ’ সিনেমায় মহ. রফির সঙ্গে ‘ও মামা ‘, গানের সেই অনবদ্য কণ্ঠ মাতিয়ে তোলে দেশকে। ক্রমশ খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিতে থাকে তাঁকে। তারপর রাজ কাপুর। যাঁর মুখে মান্নার কণ্ঠ এক নতুন যুগের সূচনা করে। ‘ও রাত ভিগি ভিগি’র অমোঘ সুর, অসাধারণ অনুভূতি আজও শ্রোতার মনকে বারবার লুণ্ঠিত করে। ভালোবাসায় আপ্লুত করে সমস্ত মায়াবি জগতকে।

‘পরেশন’ ছবিতে আসে আরেক মুহুর্ত। বাংলার আরেক সম্পদ, কিশোর কুমারের সঙ্গে যুগলবন্দী আলোড়ন তোলে গোটা দেশে। সঙ্গীতের একেকটি মহীরুহ এসডি বর্মণ, রওশন, জয় কিষান… বাংলা, হিন্দি, দেশের প্রায় কোনও ভাষার সংগীতেই তাঁর কণ্ঠের ছোঁয়া অনুপস্থিত ছিল না। সবেতেই মাতিয়েছেন কফি হাউসের আড্ডার সেই বঙ্গের মান্না।

অসাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর। নিমেষেই যেমন, নায়ক অশোক কুমারের গলায় গান গাইতে পারতেন, আবার কমেডিয়ান মেহমুদের কন্ঠেও মাতিয়ে দিতে পারতেন এই মুহুর্তেই। এমনকি এক গল্প শোনা যায় তাঁর সৃষ্টি নিয়ে। তাঁর গানের প্রভাবে নাকি, ‘উপকার’ সিনেমায়, বরাবর ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করা ‘প্রাণে’র ইমেজ বদলে দেয় ‘মালাঙ্গ চাচা’ চরিত্রের কণ্ঠে একটি গান! যা মান্না দের গাওয়া।

১৯৫৩ সালে কেরালার কন্যাকে বিবাহ, দুই কন্যা সন্তান। ১৯৭১-এ পান পদ্মশ্রী, ২০০৫ এ পদ্মভূষণ, ২০০৭-এ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার সহ, একাধিক সম্মান পান তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে গিয়ে সম্মানিত করে আসেন এই শিল্পীকে।

জীবনের ৬ দশক সক্রিয় সঙ্গীত সাধনার পর, প্রায় ৫০ বছর মুম্বইয়ে কাটানোর পর ব্যাঙ্গালোর চলে যান শিল্পী। মেয়ের কাছে থাকেন। স্ত্রী বিয়োগ ঘটে। তবুও, অশক্ত জীবনেও ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’র মতো গানের সঙ্গে লাইভ শো করেন একাধিক।

আসলে, অনবদ্য-অসাধারণ এই স্রষ্টা। তবুও বহু না পাওয়া ছিল তাঁর। উপযুক্ত সময়, আর প্রাপ্য থেকে, অধিকার থেকে কখনও তিনিও থেকেছেন ব্রাত্য। কলকাতার আবহ ছেড়ে বন্দি থেকেছেন এই প্রবাসে। দীর্ঘ অসুস্থতার পর, ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর, তিনি বিদায় নেন চিরতরে। কলকাতা না ব্যাঙ্গালোরেই প্রয়াণ হয় তাঁর।

কিন্তু সৃষ্টি যে অমর! তাই পার্থিব শরীরের বিদায় হলেও, তিনি আছেন আজও! তাঁর অমোঘ আকর্ষণ, তাঁর সৃষ্টি, আজও আছে চিরন্তন।

শুভ জন্মদিন মান্না দে…।

লেখা: রমেন দাস