হাসির প্রকাশের অন্তরালেও, এক বেদনার্ত জীবনের যেন, অন্যতম প্রতিভূ চার্লি চ্যাপলিন!

লন্ডনের একটি আনন্দমুখর সন্ধ্যা। থিয়েটারে তখন গান গাইছেন একজন মাঝবয়সী মহিলা। দর্শকাসনে বসে পাঁচবছর বয়সি একটি ছেলে গান শুনছে। জনৈক মহিলা তার মা। হঠাৎ ভদ্রমহিলার গলায় কিছু সমস্যা হল। থেমে গেল গান। মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন তিনি। সে সময় মূলত কুলি-কামিন শ্রেণীর খেটে খাওয়া মানুষ ভিড় জমাতো থিয়েটারে। গান থেমে যেতেই শুরু হল প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি। উত্তেজিত জনতাকে সামাল দিতে মঞ্চে উঠল ছোট্ট ছেলেটি। উঠে গাইতে শুরু করল “jack jones well and known to everybody “। তার সুরেলা কণ্ঠে মুগ্ধ হল দর্শক। আনন্দে স্টেজে কয়েন ছুঁড়তে শুরু করল।

ছেলেটি হঠাৎ অঙ্গভঙ্গি সহ বলে ওঠে “আমি এখন গান গাইবো না। আগে পয়সাগুলো কুড়িয়ে নিই তারপর গাইব আবার।” ছেলেটির অঙ্গভঙ্গি দেখে হোহো করে হেঁসে ওঠেন দর্শকরা। সেইদিনই বোধহয় অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল, ওই ছোট্ট ছেলেটির।

এতক্ষন যাঁর কথা বলছি, তিনি বিশ্ববিখ্যাত, বিশ্যবরেণ্য ‘দিগ্রেট চার্লি চ্যাপলিন।’–একাধারে বিখ্যাত অভিনেতা, পরিচালক ও অসাধারন শিল্পী!

তাঁর জীবন? তাও বেশ রহস্যআবৃত এবং ট্র্যাজিক। বেদনায় জর্জরিত তাঁর জীবন! জানেন কি?

তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে পিতা-মাতার নাম, সবই রহস্যময়। তাঁর জন্মের কোনো প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায়নি, তা নিয়েও রয়েছে বিস্তর ধোঁয়াশা। চ্যাপলিন নিজে একবার দাবি করেন তাঁর জন্ম ফ্রান্সে। আবার ‘আল জাজিরায়’ প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায় সম্ভবত তাঁর জন্ম রাশিয়ায়।তিনি নিজেও একবার রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। আবার কারও কারও মতে তিনি ইহুদি বংশোদ্ভূত।

আশৈশব তাঁকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। তাঁর নিজের জবানবন্দিতেই পাওয়া যায় “যদি ভাগ্য সহায় না হত, তাহলে আমি লন্ডনের পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়াতাম”। এমনকি অভাবের তাড়নায় শৈশবে তাকে বাসন মাজার কাজও করতে হয়েছিল। কাঁচের কারখানা, লোহার দোকান, ছাপাখানা, খেলনা কারখানা, কাঠ চেরাই কল তাঁর তালিকাটা বেশ দীর্ঘ।ফুটপাথে রাত কাটানো থেকে ডাস্টবিন থেকে পচা খাবার কুড়িয়ে খাওয়া বাদ যায়নি কিছুই। এমনকি একসময় বারের সামনে নেচে পয়সা রোজগার করেছেন তিনি। মাত্র নয়বছর বয়েসে তিনি যোগ দেন একটা নাচের দলে। সেখানে কমেডিয়ানের ভূমিকা পালন করতেন চ্যাপলিন। যা বেশ জনপ্রিয়ও হয়। ঈর্ষা করতে শুরু করেন ওঁর সহকর্মীরা।

১৯ বছর বয়সে যোগ দেন ‘ফ্রেড কার্ন’ থিয়েটারে। সেখান থেকেই পাড়ি জমান মার্কিন মুলুকে। ধীরে ধীরে ২৫ বছর বয়সে পা রাখেন রুপোলি জগতে। সূচনা হয় একটি নতুন গৌরবময় ইতিহাসের। জন্ম নেয় এক কিংবদন্তি। ‘দ্যা ট্রাম্প’,’দ্যা কিড’,’দ্যা গোল্ড রাশ’ একের পর এক মাইলস্টোন ছুঁতে থাকেন তিনি।

তাঁর চলচ্চিত্র জীবন গৌরবান্বিত হলেও ব্যক্তিগত জীবন ছিল বেশ বিতর্কিত এবং বর্ণময়। বারবার তাঁর নাম জড়িয়েছে নারীদের সঙ্গে। বহু নারীর আনাগোনা ঘটে তাঁর জীবনে এবং ৪ বার বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি।৪ বার বিবাহ এবং ১১ সন্তানের পিতা চ্যাপলিনের জীবনে বিতর্ক কখনো পিছু ছাড়েনি। এহেন কিংবদন্তি তাঁর শেষ জীবনটা প্রায় নিঃসঙ্গ ভাবে সুইজারল্যান্ডে কাটিয়েছিলেন। ভাবা যায়?

১৯৭৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর মারা যান চার্লি। যদিও মৃত্যুর পরেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি তাঁর। চুরি যায় তাঁর মৃতদেহ ! তার ১৬ দিন পর উদ্ধার করে পুনরায় সমাহিত করা হয়। সারাজীবন বিনোদন দিয়েছেন মানুষকে। লোককে আনন্দ দিয়েছেন তাঁর হাস্যকর কৌতুকাভিনয় দ্বারা। কিন্তু তাঁর জীবনের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায় সারাজীবন কেটেছে তাঁর দুঃখে। কখনও লড়াই করেছেন দারিদ্রের সঙ্গে আবার কখনো ব্যক্তিগত সমস্যায় হয়েছেন জর্জরিত। যে সুখপাখির সন্ধান করেছেন সারাজীবন তা অধরাই রয়ে যায় তাঁর জীবনে। বিচিত্র মুখের ভাবভঙ্গি দেখে দর্শক যতই হাসুক কোথাও হয়ত ওই মুখের রেখার ভাঁজে লুকোনো থাকত দমচাপা কান্না, দীর্ঘশ্বাস। তাই, কমিক-হিরোর ব্যক্তিগত জীবনটা ট্র্যাজিক হয়েই বোধহয় রয়ে গেছিল!

১৭.০৪.২০২০

লেখা: স্বাতী সেনাপতি

#Special

#Edited