উন্নত দেশগুলোতে, সরকার স্বীকৃত চিকিৎসকের লেখা প্রেসক্রিপশন ছাড়া প্রায় কোনও ওষুধই পাওয়া যায় না, সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের দেশে, অর্থাৎ এখানে মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধ কোনও রেজিস্টার্ড বা স্বীকৃত চিকিৎসকের লেখা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হয় অনবরত।
মানুষজন যেন, দোকানে যান মহানন্দে, “একটা প্যান-ফরটি দিন তো। কিংবা দু-তিন বার পেট খারাপ হয়েছে বা গলা খুসখুসে কাশি, একটা ওষুধ দিন না!” দোকানদাররাও দেদার বিলিয়ে দেন ওষুধ। যিনি দোকানে গেলেন, তিনি হয়তো মনে মনে ভেবে নিয়েছিলেন–“হাত বাড়ালেই ওষুধ। আর কি চাই? সাধারণ সর্দি-কাশি, পেটখারাপের জন্য কেউ ডাক্তার দেখায় নাকি? বুকে চাপ? ও কিছু
গ্যাস না…. জমেছে। অজ্ঞান? ধুর… গ্যাসের
ওষুধ খাওয়াও… মাথায় গ্যাস উঠেছে।”
এভাবেই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে “ব্রট ডেড বা নিয়ে আসা মৃত ব্যক্তি” আমরা আসতে দেখি, যাঁর বাড়ির লোকেরা বিগত আটঘন্টায় বুকের ব্যথায় গ্যাসের ওষুধ খাইয়েছেন দোকান থেকে আনিয়ে।
এতো গেল রোজকার চিত্র! এবার আসি করোনা আক্রান্ত ভারতবর্ষে। বহু মানুষ আক্রান্ত। সংখ্যা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিষেবা দিচ্ছি যাঁরা। অর্থাৎ জরুরি পরিষেবা প্রদানকারীদের মধ্যে, সর্বাধিক ‘রিস্কে’ রয়েছেন, চিকিৎসক এবং সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা। এঁরাই করোনা ‘সাসপেক্টেড’, অথবা ‘করোনা পজিটিভ’ রোগীর সংস্পর্শে আসছেন, প্রতিনিয়ত।
কিন্তু এঁরা হুজুগে মেতে উঠে ওষুধ না খেলেও,
গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। কিছুদিন আগে ICMR, একটি গাইডলাইনে জানায় একটি ওষুধের কথা। যার নাম, ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন’। যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে। করোনা সেরে যাওয়ার কোনও নিশ্চিত তথ্য না দিলেও, এই ওষুধ সম্পর্কে চিকিৎসকরা জানান, যাতে করোনা সংক্রামিত ব্যক্তির থেকে, সরাসরি স্পর্শে থাকা ব্যক্তিদের রোগ না ছড়িয়ে পড়ে, সেইজন্য হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামক ওষুধটি ব্যবহৃত হতে পারে ভবিষ্যতে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য, এই ওষুধ ব্যবহার করার কোনও নির্দেশিকা ছিল না।
তবে এদেশ, মোমবাতি জ্বালাতে বললে বাজি ফোটায়, মশাল জ্বালে, আকাশে ঝলমল করে বারুদের আগুন। শবেবরাত উপলক্ষেও বাজি ফোটে। এই অসময়েও তাই-ই হল। এক্ষেত্রেও হুজুগে মেতে উঠল বিরাট অংশের মানুষ। অমনি, আমাদের পোড়া কপালকে দাগিয়ে দিল আবার ! যেইমাত্র সরকারি ভাবে ঘোষিত হলো–”অমুক ওষুধ পরীক্ষামূলক ভাবে করোনাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও মিলেছে”… অমনি, সেই ওষুধ লোকে মুড়ি-মুড়কির মতো কিনতে লাগলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই ওষুধ তাঁরা পেয়েও গেলেন বিনা প্রেসক্রিপশনেই! নিমেষেই ওষুধের ঘাটতি শুরু হল বহু দোকানে। শেষমেশ এমন পরিস্থিতি দাঁড়ালো যে, সরকারের তরফ থেকে নির্দেশিকা প্রকাশিত হলো–“রেজিস্ট্রার্ড ডক্টরের বিনা প্রেসক্রিপশনে, এই ওষুধ যেন বিক্রি না হয়।”
অথচ এখন বাজারে এই ওষুধের আকাল, আরও অন্য যে সব রোগের চিকিৎসায় এই ওষুধ ব্যবহৃত হতো, সেইসব রোগীরা মারাত্মক সমস্যায় পড়লেন। এই ওষুধ তাঁরা পাচ্ছেন না! যাঁদের প্রয়োজন নেই, অভিযোগ করছেন কেউ কেউ, তাঁরা অনেকেই নাকি ঘরে রেখে দিয়েছেন ওষুধ! কিন্তু, কেউ একবারও সরকারি নির্দেশিকা পড়ে দেখার প্রয়োজনও অনুভব করেননি, শুধুমাত্র আধো-আধো ঘোষণা শুনেই, ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এই ওষুধ কিনতে।
কিন্তু কী বলা হয়েছিল সেখানে? এই ঘোষণায় বলা ছিল, শুধুমাত্র সন্দেহজনক রোগী এবং তাঁর চিকিৎসায় যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা প্রমাণিত কোভিড-১৯ রোগীর এবং তাঁর দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জন্য এই ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া, কোনও ‘গাইডলাইন’ই এখনও পুরোপুরি ভাবে, সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত নয়, এখনও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। এমনটাও বলেন বহু বিশেষজ্ঞরা। আমরাও বারবার বলতে থাকি। অথচ, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই দেদার বিকিয়ে গেল ওষুধ! যেন হঠাৎ আকাল দেখা দিল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের। এখন ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হলেও, মুহূর্তেই বিক্রি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে, এখন প্রায় অমিল তা। সেটা কেন জানেন? শুধুই গুজবের বশে! আর এখনও রোজ কেউ খুঁজে চলেছেন ওষুধ! কেন আপনাকে খেতে কে বলেছেন?
তবুও, দেখা গেল মাস্ক পরে ছবি তোলার মতোই, এক্ষেত্রেও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তারিয়ে তারিয়ে খেলেন বা ঘরে জমালেন বহু দেশবাসী। তবে শুনবেন আসল কাহিনী? খাওয়ার আগে একবার শুনে নিন। দেখুন তো আর হুজুগে বাঁচবেন কিনা!
বেশিকিছু না, শুধু ‘সাইড এফেক্ট’গুলো বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুনলে যদি আমজনতা সতর্ক হন! এই ওষুধের পরিমাণ অথবা আপনার ক্ষেত্রে অযথা প্রয়োগ যদি ঘটে, তাহলে একেবারে সাধারণ সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে প্রথমত, তা হল: সাধারণ বমিভাব, পেটখারাপ, এগুলো খুব সাধারণ উপসর্গ। এটা ছেড়ে দিন, আরও আছে, হৃৎযন্ত্রের ছন্দপতন, হার্ট ফেলিওর, চোখের রেটিনার গন্ডগোল, রক্তাল্পতা, ব্রণ, চুল উঠে যাওয়া, খিঁচুনি, দেখতে সমস্যা, শুনতে না পাওয়া, কান ভোঁভোঁ করা, অন্যান্য অ্যালার্জি, লিভার ফেলিওর, সোরিয়াসিস ও পরফাইরিয়ার মতো চর্মরোগ বেড়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা।
একবার ভেবে দেখুন তো? গুজবে এই ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শে না খেলে কী কী হতে পারে আপনার!এতকিছু থাকলে, ঈশ্বর না করুন, নিজের মতো করে যথেচ্ছ ওই ওষুধ খেলে, আপনার করোনার জন্যে মৃত্যু হতে হলেও, এর জন্য হতে পারে! হ্যাঁ! হতেই পারে।
কিছু না জেনে, না যাচাই করে ওষুধ খেতে ওস্তাদ আপনারা। আর এই হলো মহান কিছু ভারতবাসীর কার্যকলাপ। আর খাবেন না, শান্তি দিন আমাদের!
ভালো থাকুন। অযথা ভুল কাজ করে চিন্তা না বাড়িয়ে, সচেতন হতে পারেন তো!
আর বলতে পারি না আমরা? ভুল ওষুধ না কিনে, একযোগে যদি, আমি বেঁচে থাকি, যদি আপনি বেঁচে থাকেন, তবে দাবি উঠুক না সর্বত্র। যেন–“এরপর থেকে রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ওষুধ দোকান থেকে দেওয়া না হয়।”
শুধু দাবি তুললেই হবে না। সেটা পালন করুন। দোকান থেকে নিজে নিজে ওষুধ কিনবেন না। নয়ত একদিন হয়ত দেখবেন– গলা খুশখুশের ওষুধ বলে যেটা এতদিন খেয়ে খেয়ে সাবাড় করে দিয়েছেন, সেটাই নতুন কোনো রোগের মহৌষধী।আর একটা কথা, এখন যাঁরা কান্নাকাটি করছেন আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দেখে, এখন কাঁদলে হবে? এতদিন কোথায় ছিলেন? স্বাস্থ্য বাজেটের সময়? শুধু এটুকু জেনে রাখুন ওই, ‘প্রায় নেই’ এই স্বাস্থ্যবরাদ্দ নিয়েও লড়ে যাচ্ছি আমরা, স্বাস্থ্যকর্মীরা। চিকিৎসক, নার্স- সবাই লড়ে যাবেই । থাকব যুদ্ধ জয়ের সামনের সারিতে। শুধু, আপনারা ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। এখানেই তো আমাদের স্বার্থকতা!
লিখলেন, চিকিৎসক আশিক ইকবাল
আরজি. কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কলকাতা।
১০.০৪.২০২০
Edited by RD, ww.khoborwalatv.com
©️All rights reserved