মানুষের যেসব বৃত্তিকে লোকে এতদিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞানী- সকলকেই এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরি-ভোগী শ্রমজীবীরূপে।’- কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে বহু এই কথাই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। এসেছে রূপকের আড়ালে। ‘রূপক’ অর্থে বোঝায় আসল ঘটনা শিল্পের মাধ্যমে দর্শকের কাছে পৌছে দেবার জন্য যার সাহায্য নেওয়া হয়। অর্থাৎ যা বলতে চাওয়া হচ্ছে তা সরাসরি না বলে কোনও কিছু প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরা। আর রূপকের গভীর ব্যবহার সত্যজিৎ রায়কে বারবার করে তুলেছে অনন্য। দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে তাঁকে এনে দিয়েছে মৌলিকত্বের সম্মান। তাই আজ তাঁর জন্ম শতবার্ষিকীতেও ঘুরে ফিরে বারবার আসে তাঁর কাজের প্রসঙ্গ। তাঁর কাজের রূপকধর্মিতার আড়ালে গভীর ব্যঞ্জনা, সমাজকে তর্জনী তুলে চোখে আঙুল দিয়ে সত্যিটা দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়াস এই প্রসঙ্গে সবার প্রথম যে সিনেমাটির নাম অগ্রগণ্য তা হল হীরক রাজার দেশে। ছোটদের ছবির আড়ালে, রূপকথা এবং ফ্যান্টাসির আড়ালে নির্মম বাস্তবকে চরম ভাবে তুলে ধরা। আদতে রূপকের আড়ালে আদ্যোপান্ত একটি রাজনৈতিক ছবি।
এক্ষেত্রে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে আইকনিক চরিত্র উদয়ন পন্ডিত। যাঁকে ছবির শেষের দিকে দেখা যাক হীরক রাজা সহ পরিষদদের মগজধোলাই ঘরে ঢুকিয়ে উদয়ন পন্ডিত মগজধোলাইয়ের মন্ত্র দিচ্ছেন “অনাচার কর যদি রাজা তবে ছাড়ো গদি। যারা তার ধামাধারী, তাদেরও বিপদ ভারী।”
অতঃপর একদম শেষ দৃশ্য যেখানে সকল দেশবাসী, প্রজারা মিলে রাজার বিশাল মূর্তি টেনে ফেলে দিচ্ছে “দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান।” সেখানে একে একে যোগদান করছেন রাজা সহ বাকি পারিষদরা। প্রসঙ্গত এই ছবি যখন তৈরি হয় তখন দেশে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। দেশে চলছে ইমার্জেন্সি পরিস্থিতি। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই ছবি কি প্রতিবাদের স্বরূপ হয়ে ওঠেনি?
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বব্যাপি উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, ফ্যাসিস্ট মনোভাব, রাজার অনাচার, রাজধর্ম পালনে অক্ষমতা, অবহেলিত কৃষক শ্রমিকদের চোখের জল, স্পষ্টবাদীদের শাস্তি প্রদান এই পরিস্তিতিতে দাঁড়িয়ে উদয়ন পন্ডিতের প্রাসঙ্গিকতা কি যথেষ্ট নয়? হয়ত আজকের দিনে এমন সিনেমা বানালে তাঁকে হইহই করে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হত।
শুধু এটুকুই না, হীরক রাজার দেশের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সমকালীন সমাজে কৃষক শ্রমিক মানুষের যন্ত্রনার কথা। যেমন যন্তর মন্তর মগজধোলাই ঘরে কৃষকের জন্য মন্ত্র হল “বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না’, ‘ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই, ‘যায় যদি যাক প্রাণ হীরকের রাজা ভগবান’। বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক মৃত্যুর সাথে কি মিল তাইনা ? আর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মগজধোলাই আরও ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। সোশ্যাল মিডিয়া, গণমাধ্যমে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সব স্তরে। গিলছে মানুষ। হচ্ছে মগজধোলাই। এইভাবেই তো ফ্যাসিবাদের বীজ চারিয়ে যায় সমাজের শিরায় উপশিরায়।
‘এরা যত বেশি জানবে, তত কম মানবে’ তাই হীরক রাজার দেশে পাঠশালা বন্ধ হয়েছিল। তাই জন্যই কি শিক্ষা খাতে আমাদের দেশে বরাদ্ধ সবচেয়ে কম!!! সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি !! কিন্তু যুদ্ধ যে তা তিনি গুপি বাঘা সিরিজের প্রথম ছবি গুপি গাইন বাঘা বাইনের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
যুদ্ধের প্রসঙ্গে আরও একটি ছবি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ‘টু’ বা ‘two’ এই স্বল্পদৈঘ্যের ছবিটি বানানো হয় আমেরিকা এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু ছবিটিতে আবহ ছাড়া কোনও শব্দের প্রয়োগ নেই। আছে শুধুই রূপক। শব্দহীন একটি ছবি ভীষণভাবে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে কেবল রূপকের ব্যবহারে। ভাষা পায়, প্রাণ পায়। হয়ে ওঠে নিস্বব্দ প্রতিবাদের ভাষা। তাতে দেখা যায় ছবির দুটি শিশু চরিত্র। একটি ধনী শিশু চরিত্র মিকি মাউসের টুপি মাথায় কোকাকোলা পান করছে। যা আমেরিকার প্রতীক!! অপর শিশু হতদরিদ্র মলিন বস্ত্র। শিশুর মুখের আদল খানিক মঙ্গলয়েড। যা ভিয়েতনামের প্রতীক। ধনী বাচ্চাটির উদ্ধত খেলনা বন্দুক সেখানে যুদ্ধের প্রতীক হয়ে ওঠে।
শুধু সত্যজিৎ রায়ই নন, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী থেকে শুরু করে লীলা মজুমদার, সুকুমার রায়, রায় পরিবারের সবাই কম বেশি রূপকের আড়ালের বাস্তবের চালচিত্র অঙ্কন করেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সুকুমার রায়ের ননসেন্স ঘরানার কবিতাগুলি। যা হাস্যরসের আড়ালে আদতে নির্মম বাস্তবকে উপহাস করেই। কাজেই এসবের প্রভাব সত্যজিত রায়ের উপর ছিল বলাই বাহুল্য। যা তাঁর গভীর মুনিশিয়ানার সাক্ষর আজও বহন করে নিয়ে চলেছে। তাই বলা যায় রূপক মানেই সত্যজিৎ। সত্যজিৎ মানেই রূপক। আজ তাঁর জন্ম শত বার্ষিকীতে বারবার সেই কথাই প্রতিধ্বনিত হয়।
০২.০৫.২০২০
কলকাতা
ছবি সৌজন্যে: টুইটার
লেখা: স্বাতী সেনাপতি