শিল্পের বিকাশ অবরুদ্ধ, করোনার গ্রাসে শিল্পহীন অচেনা এক ভারতবর্ষ

যা তৈরি হাতে তাই হস্তশিল্প | প্রাথমিকভাবে নিজের হাতে যা কিছু তার রূপদান করাকেই বলা যায় হস্তশিল্প | কতিপয় হস্তশিল্প পণ্য রয়েছে যেগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়| এসব বৈশিষ্ট্যের উৎস হচ্ছে একটি অঞ্চল বা দেশ বা কোনো রাজ্যের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কারুশিল্পীদের বিশেষ উৎপাদন|

বর্তমানে ভারতে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলগুলিতে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস এই হস্তশিল্প বা হ্যান্ডিক্রাফটস| বর্তমানে এর প্রসার বেড়েছে দেশে-বিদেশেও| এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভারত সরকারের তরফে আলাদা এক বিভাগ খোলা হয়েছে | আদি ও মধ্যযুগীয় সময় থেকে বাংলা তথা বিভিন্ন রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হস্ত ও কুটির শিল্প| বয়ন, ধাতব পদার্থের কাজ, জুয়েলারি, বিশেষ করে রুপার তৈরী অলংকার, কাঠের কাজ, বেত এবং বাঁশের কাজ, মাটি ও মৃত শিল্প হস্তশিল্প হিসেবে প্রসিদ্ধ|

প্রসঙ্গত, এই হ্যান্ডিক্রাফট একটি পড়াশোনার বিষয় হয়ে উঠেছে যার কারণে অর্থনীতি ও বেশ কিছুটা লাভবান হচ্ছে| শহরের গ্রামের মেয়ে বউরাও এগিয়ে আসছে নতুনত্ব হ্যান্ডিক্রাফটস- র কাজে| বাড়ির অনাবশ্যক জামা কাপড়, ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে অনায়াসে হয়ে উঠছে জুয়েলারি, ঘর সাজাবার জিনিস, আরো অনেককিছু| বিদেশেও এর প্রাধান্য বৃদ্ধি পাচ্ছে| শাসকশ্রেণি এবং অভিজাতশ্রেণি এই সমস্ত দ্রব্য ব্যবহার করত বলে হস্তশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। হস্তশিল্প তৈরিতে কারিগরগণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা মূলত তাদের পরিচিত লোকদের জন্য কাজ করতো আগে এবং এই কারণেই তাদের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে লক্ষণীয়ভাবে ব্যক্তিগত রুচি এবং আন্তরিকতার ছাপ থাকত। হস্ত শিল্পের মধ্যে পড়ছে পাট ও চামড়া শিল্প রকমারি হস্তশিল্পের বিকাশ বৃদ্ধি পাচ্ছে শিল্পীদের হাত ধরে|

এই মুহূর্তে করোনার গ্রাসে স্তব্ধ গোটা দেশ, শিল্পের বিকাশ অবরুদ্ধ | করোনার কারণে সামগ্রিকভাবে লকডাউনের ঘেরাটোপে দেশ তাই ভয়ঙ্কর ভাবে বিপদে পড়েছেন হস্তশিল্পীরা| ‘করোনা মহামারীটি আমাদের পিঠ ভেঙে দিয়েছে’, বললেন ওড়িশা গ্রামের একদল সবাই ঘাসের ঝুড়ি প্রস্তুতকারীদের এক সদস্যা আরতি পাত্র| রাজকুমারী যোশী, একজন হস্তশিল্পী বলেন সে রাজস্থানে একজন মহিলার সহায়তা হস্তশিল্পের কাজ করে থাকেন | তিনি জানান ‘এখানকার কর্মরতা মহিলারা সম্পূর্ণ অসহায় এবং প্রয়োজন বোধ করছেন, আমাদের কাজ নেই, অন্যান্য কারিগররা এটা ভেবে অবাক হয় যে কিসে তারা আগে কিসে শেষ হবে ভাইরাস না ক্ষুধায় !’ দস্তাকার নামক একটি হ্যান্ডিক্র্ফটস সংস্থা দুঃখ প্রকাশ করে জানায়, ‘এটি একটি কৌতুহলী সময় কেবলমাত্র একটি মারাত্মক রোগের ভয় নয় সমস্ত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়া-কলাপের একটি লকডাউন, দৈনন্দিন উৎপাদন ও বিক্রয় নির্ভর কারিগরদের জন্য জীবন থমকে দাঁড়িয়েছে – এখানে কোনো মেলা, কাঁচামাল নেই, তাদের পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য কোন অর্থ নেই, আমরা কয়েক দশক ধরে একসাথে কাজ করছি এখন আমরা সবাই একে অপরের সাথে ব্যথা ভাগ করে নিচ্ছি|’

রাজস্থানি এক কুমোর বিমলকুমার বলেন, ‘আমাদের সব অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও কমপক্ষে দুই বছর ধরে এই সব জিনিস বিক্রি করতে পারবো না, এটি কেবলমাত্র বিক্রিতে নয় উৎপাদনেও হ্রাস ঘটাবে|’ বিভিন্ন ভিডিও সোশ্যাল-মিডিয়ায়-ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় লকডাউনের মধ্যেও কাজ না থাকায় ক্ষুধার টানে বেকার অভিবাসী শ্রমিকরা অবিশ্বাস্যভাবে বাড়ির দিকে হাঁটা দিচ্ছে, তবে এর বাইরে মিডিয়া বা সরকারের আড়ালে অদৃশ্য থাকে ক্ষতিগ্রস্থ বহু কারিগররা, নিয়মিত বেতন বা সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জলের বাইরে অসহায় হয়ে পড়েছে তারা|
বিশ্ব অর্থনীতিতে ৩ শতাংশ ভূমিকা পালন করে হস্তশিল্প| এমনকি ইতালীয় ফ্যাশন হাউজ আরমানি এই হস্তশিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে সুরক্ষামূলক ওভারলস ও লুই ভুটান বিলাসবহুল লাগেজের পরিবর্তে তৈরি করছে মাস্ক হস্ত কারিগরদের আয়ের সুবিধার্থে| তিন সপ্তাহ আগে রাজস্থানের দস্তকর নামক সংস্থা তার কারিগরি সহায়তা তহবিল চালু করেন, অনলাইন একটি পোর্টালর মাধ্যমে জয়পুরের অনুসারে সমর্থিত উদ্যোগ থেকে প্রাপ্ত অর্থ কারিগর পরিবারগুলিকে দেয়| এই দস্তকার সংস্থাটি একটি অভিনব উদ্যোগ শুরু করে, শাড়ি শিল্পের প্রসার বাড়ানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় পুরুষদের শাড়ি পরা একটি ভিডিও শুট করে পুরুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মহিলাদের প্রতি সন্মান জানানোর জন্য| করোনা ভাইরাসের জন্য তহবিল গড়তে ও মহিলাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করতে মূলত এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে| প্রসঙ্গত, যদিও অনেকেই আশংকা করেছেন কোভিড-১৯ র প্রভাব কারিগরদের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়বে, তবে সরকার যদি জিএসটি অপরিকল্পিতভাবে না চাপিয়ে দেয় তবে পরবর্তীকালে হস্তশিল্পের সৃজনশীলতা ও নমনীয়তা বৃদ্ধি পাবে| ২০০১ এর ভূমিকম্পের কথা মনে করে আজরাখের মাস্টার কারিগর ইসলামভাই তার বিধ্বস্ত বাড়ির ধ্বংসাবশেষে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ‘আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াবো, নিজের পায়ে দাড়াবো, আমরা আবার আমাদের নিজের জীবন পুনর্নির্মাণ করবো|’ সেই স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অস্থায়ী কর্ম-কেন্দ্রগুলি বসে, ভারতবর্ষের সব হকারদের কাছে তিনি আবেদন জানান এগিয়ে আসতে, তার কাছে কর্মরত মহিলারা সূক্ষ্ম সূচিকর্মে তৈরী করছেন মাস্ক, বাজজুতে উৰ্মূল সীমন্ত নামে এক ব্যক্তি প্রথম দুই সপ্তাহে পাঁচ হাজার মাস্ক তৈরী করেন| গুজরাটের হিরা ভাই এবং লক্ষ্মীবেইন চৌহান উভয়ই ৭০ বয়সোর্ধ, তাঁরা এপলিক শিল্পী, সারা জীবন তাঁরা প্রসংশিত হয়ে এসেছেন তাঁদের কাজের জন্য, কিন্তু হঠাৎই বিক্রি বন্ধ | অবশ্য তাঁরা এই লকডাউনে নতুন ডিজাইন তৈরী করছেন পরবর্তী প্রদর্শনীর জন্য| এর পাশাপাশি বাংলায় শান্তিনিকেতনে গোটা শহর প্রসিদ্ধ হাতের কাজের জন্য, সোনাঝুরি হাটে বসে পসার | বীরভূম জেলা বিখ্যাতই মাটির কাজের জন্য | লকডাউনের জেরে সব বন্ধ, নির্বিকার শিল্পীরা কারণ সেখানকার বহু মেয়ে বউরা সংসার চালান হার কানের দুল বানিয়ে বিক্রি করে| সেখানকার মানুষের প্রধান জীবিকাই এই হস্তশিল্প| প্রাসঙ্গিকভাবে দেখতে গেলে হস্তশিল্পের সাথে সাথে ক্ষতি হচ্ছে পর্দায় ও পর্দার আড়ালে কাজ করা শিল্পী ও কলাকুশলীদেরও| বহু মানুষ এমন আছে যারা দিনের কাজের ভিত্তিতে টাকা পান, এই পরিস্থিতিতে স্টুডিও পাড়া বন্ধ, শুটিং বন্ধ ফলে আয়ও বন্ধ| বহু সিনেমার মুক্তি অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছিয়েও দেওয়ায় হয়েছে| বহু জায়গায় চিত্রশিল্পীরা পোস্টার আঁকার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন সচেতনতার বার্তা| রাজস্থানের ভিলওয়ায় স্থানীয় এক চিত্রশিল্পী কল্যাণ যোশী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেছিলেন একাধিক পোস্টার| সর্বপ্রথম এই ভিলওয়ায় ভয়ঙ্করভাবে করোনা সংক্রমণ ঘটলেও তা এখন সম্পূর্ণ করোনামুক্ত| দুঃখজনকভাবে ক্রাফটস একটি অপরিহার্য বা প্রয়োজনীয় বস্তু নয়, মানুষ এই জিনিসগুলি কে বিলাসের সারিতেই রাখতে বেশি পছন্দ করে| তাই বিভিন্ন কারুশিল্প ও সেইসব সংলগ্ন সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা অর্থনৈতিক সমাধান প্রয়োজন, কারণ বানানো স্টকে থাকা জিনিসগুলি পরিবর্তিত বাজারে পুনরায় কিভাবে বিক্রয়জাত হয়ে উঠবে তার একটি পরিকল্পনা করা দরকার সরকারকে|
২৫/০৪/২০২০
রিপোর্ট – রুমকি সরকার
চিত্র সূত্র – গুগল