“তুমি আমার কাছে প্রকাশিত হও তাহলেই । এধি—হে আবিঃ হে প্রকাশ, তুমি ত চিরপ্রকাশ, কিন্তু তুমি একবার আমার হও, প্রকাশ পূর্ণ হোক! হে রুদ্র হে ভয়ানক— তুমি যে পাপের অন্ধকারে বিরহরীপে দুঃসহ রুদ্র, স্বত্তে দক্ষিণংমুখং, তোমার যে প্রসন্নস্কন্দয় মুখ, তোমার যে প্রেমের মুখ, তাই আমাকে দেখাও—তেন মাং পাহি নিত্যমৃ—তাই দেখিয়ে আমাকে রক্ষা কর, অামাকে বাচাও, আমাকে নিত্যকালের মত বঁাচাও—তোমার সেই প্রেমের প্রকাশ, সেই প্রসন্নতাই আমার।”
উপনিষদের এই গভীর কথা যিনি সহজ করে বলে গিয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।উপনিষদের এই গভীর উপলব্ধির বীজ তাঁর মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল একদম ছোটবেলাতেই। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সন্তানদের প্রতিদিন, উপনিষদের শ্লোক পড়াতেন, তর্জমা করে দিতেন। বালক রবীন্দ্রনাথের মনে তখন থেকেই এর অনুরণন ঘটতে শুরু করে। ঈশ্বর এবং তাঁর বিশালতার ব্যাপ্তি এর অনুভূতির প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে যখন তিনি কৈশোরে তাঁর পিতার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণে যান।
রবীন্দ্রনাথের ৮০ বছরের পরিপূর্ণ জীবনের তাঁর মনন, চিন্তন এবং লেখায় যে আধ্যাত্মিকতার ভিত্তিভূমি হল ভারতের প্রাচীনতম সনাতন ধর্মের সুপ্রাচীন শাস্ত্র উপনিষদ। তাঁর নিজের কথায় ‘আমার জীবনের মহামন্ত্র পেয়েছি উপনিষদ থেকে’। পরবর্তী কালে যা তার কাব্যগ্রন্থগুলির ছত্রে ছত্রে প্রতিফলিত হয়েছে।
কথায় বলে ‘ব্রাহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণম’ অর্থাৎ যিনি নিজের ক্ষুদ্র সত্ত্বার মধ্যে ব্রহ্মহের বিশালত্ব কে উপলব্ধি করেন তিনিই ব্রাহ্মণ। এই ব্রহ্মের উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত জীবন ব্যাপি। তিনি সারাজীবন এই ব্রহ্মের অনুসন্ধান করে গেছেন।রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, উপনিষদের সব পুরুষ ঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটি নারীর ব্যাকুল বাণী ধ্বনিত মন্ত্রিত হয়ে উঠেছে – যা কখনোই বিলীন হয়ে যায়নি, তিনি জানতেন অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়। রুদ্র যত্তে দক্ষিণাং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম।অর্থাৎ, হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও, হে প্রকাশ, তুমি একবার আমার হও, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ন হোক। তাঁর সৃষ্টি, জীবনবোধ এবং সেই অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা সব কিছুতেই ছিল গভীর ঈশ্বরচিন্তা।
প্রথম যে কাব্যগ্রন্থটিতে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তার আভাস পাওয়া যায় , সেটি হল ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থ।
ধীরে ধীরে তাঁর ঈশ্বরচিন্তার পরিপূর্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে গীতিমালা, গীতালি ও ধর্মসংগীত প্রভৃতি কাব্য এবং গীতিসংকলনে। ব্রহ্মপনিসদ, ব্রহ্মমন্ত্র, উপনিষদ ব্রহ্ম, ভারতবর্ষ, মানুষের ধর্ম, ধর্মের অধিকার প্রভৃতি গদ্যগ্রন্থে বিকশিত হয়েছে তাঁর ঈশ্বরচিন্তা।
তিনি বারবার বলেছেন ‘কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমার ধর্ম নয়।আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন, আমি পন্ডিতহারা, আমি তোমাদেরই লোক’। কোনও বিশেষ ধর্ম নয়, শান্তি, মৈত্রী, ব্রহ্মের কাছে নিজেকে বারবার সমর্পিত করতে চেয়েছেন। শুধু কাব্যগ্রন্থই নয় এই আকুলি দেখা গেছে তার গানেও।’আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার পরে’ গানের এই কথা গুলিতে আত্মসমর্পণের আকুতি ফুটে উঠেছে। শুধু এই গান নয় ব্রহ্মসঙ্গীত, প্রার্থনা সংগীতে বারেবারে তিনি ক্ষুদ্র আমিত্ব কে বিশালত্বের কাছে বিলিয়ে দিতে চেয়েছেন। ঠাঁই চেয়েছেন ঈশ্বরের কাছে।
তাঁর সৃষ্টির আধার ছিল উপনিষদ, পরম ব্রহ্ম, সত্য কে উপলব্ধি করা। উপনিষদের শিক্ষাকে তিনি অন্তরের অন্তঃস্থলে সত্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন যা তাঁকে করে তুলেছিল ব্রহ্মপাসক। তিনি বলেছেন ‘ উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্ম জ্ঞানের বনস্পতি’।
তাঁর এই ব্রহ্ম সাধনার মার্গ তাঁকে করে তুলেছে চিরকালীন। যা দেশ, কাল গন্ডির সীমানা ছাড়িয়ে তাকে দিয়েছে ঋষির মর্যাদা। করে তুলেছে অমরত্বের পথিক।
_________________________________________
স্বাতী সেনাপতি