পৃথিবীতে যদি শর্তসাপেক্ষহীন কোন শব্দ থেকে থাকে তাহলে তিনি হলেন ‘মা’ | এই শব্দের বিস্তার সব সম্পর্কের ঊর্ধ্বে| মাকে নিয়ে লিখতে বসলে লেখা শেষ হওয়ারই কোন প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায় না| মা শব্দের সরলতা ও প্রাধান্যতা বোঝাতে লেখা হয়েছে অনেক কবিতা, উক্তি যার কোনোটাই মনে হয় যথেষ্ট নয়| মাতৃত্বের সাথে কতগুলো শব্দ প্রতিচ্ছবির মতন ঘুরে বেড়ায় দায়িত্ব-কর্তব্য, অপরিসীম স্বার্থহীন ভালোবাসা| বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সুস্মিতা সেনকে জিজ্ঞাসা করা হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মাইনের চাকরি কি হওয়া উচিত, তিনি বলেছিলেন ‘মা ‘ তবু কেন জানিনা বেশি কম নিয়ে হয়তো বিচার করা যায়না ‘মা’ মানুষটিকে, কিন্তু পৃথিবীতে মা হওয়ার স্বাদ বহু জন আবার পায়না আবার যারা মা হতে চায় তারা সমাজের গোঁড়ামি ভেঙে মা হয় অন্য রূপে অন্য অর্থে| চারিদিকে এত বিদ্বেষ, ঘৃণা, লড়াই, ধর্ম, জাতপাত, শুধু মা শব্দের মাঝে এর ছাপ পড়েনি, ছাপ পড়তে পারেনা| যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন মাকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু হয়েছি, যা কিছু হতে আশা করি, এর সবকিছুর জন্য মায়ের কাছে ঋণী।’ অবশ্য ‘ঋণী’ শব্দটাও যেন বেমানান, অর্থহীন ‘মা’ শব্দের পাশে|
মনে পড়ে সিরিয়ার সেই ঘটনা যা গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল চোখের পলকে| সিরিয়ার শরণার্থীশিবিরে একটি শিশু গাছে লিখেছিল, ‘মা, তুমি যেখানেই থাকো, সেখানেই আমাদের ঘর।’ সেখানকার মা ও শিশুদের এর থেকে বেদনার সময় আর কখনও হয়তো ছিল না।
সমাজে কিছু মায়েরা দেখিয়ে দিয়েছেন গর্ভে না ধরলেও মাতৃত্ব অনুভব করা যায়, মা হওয়া যায়|আজ সেরকমই কিছু মায়ের কথা তুলে ধরা হল।
সিন্ধুতাই সাপকাল একজন দুজনের না ১৪০০ সন্তানের মা কি অবাক হচ্ছেন না হবারই কথা! ৭০ বছরের এই মহিলা নিজের এই মাতৃত্বের জন্য পেয়েছেন ৭৫০ টি পুরস্কার যেটা যথার্থ নয় কারণ মাতৃত্বের কোনো সীমাবদ্ধতা থাকে না| সিন্ধুটাই সাপকাল অনাথের ‘মা’| মায়ের কোলে ঝুলিতে পুরস্কার দিয়ে কি আর এই শব্দের যথার্থতা প্রকাশ করা যায় কোনদিন ওই যায় না| তিনি জন্মগ্রহণ করেন, ১৪ নভেম্বর,১৯৪৮ সালে মহারাষ্ট্রর ওয়ারধা জেলায় | একজন অবাঞ্ছিত সন্তান, হওয়ার দরুন তার ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল ‘ছিন্ধি’ (ছেঁড়া টুকরা কাপড়)। এই বয়সেও বাড়িয়ে দেন স্নেহের হাত। কোলে তুলে নেন তাদের, যারা মায়ের কোল থেকে আস্তাকুঁড়ে জায়গা পায়। যারা এই জগতে অবাঞ্ছিত জন্মদাতা-দাত্রীদের কাছে, যারা শুধু সংখ্যা হয়ে থাকে। এদের দিকে ফিরেও তাকায় না সুশীল সমাজ। তাঁর সেই পালিত পুত্র কন্যারা অনেকেই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মধ্যে আছেন ডাক্তার, আইনজীবি , অধ্যাপক| ‘মি সিন্ধুতাই সপকাল'(আমি সিন্ধুতাই সপকাল) নামে তাঁর জীবনী নিয়ে মারাঠি সিনেমা পেয়েছে জাতীয় পুরস্কার| তাঁর মত হতদরিদ্র পরিবারে বিদ্যার্জন বিলাসিতা। মাত্র দশ বছরেই বিয়ে হয়ে যায় সিন্ধুর। ওই বয়সে বিবাহ সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না তাঁর। দশ বছর পরে জন্ম হয় তাঁর একমাত্র কন্যা মমতার| সেইসময় তাঁকে প্রবল অত্যাচার করে গোয়ালঘরে মরার জন্য ফেলে দেয় স্বামী। নিজেই সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর কথায়, নিজের নাড়ি পাথর দিয়ে নিজেই কাটলাম। তখন একটু সাহায্যর জন্য দোরে দোরে ঘুরেছিলাম। কেউ কোনও সাহায্য করেনি। স্বামী ত্যাগ করেছিল আগেই। এমনকী নিজের মায়ের কাছ থেকেও কোনও সাহায্য পাইনি। তবু হেরে যাইনি জীবন যুদ্ধে। এইসব না পাওয়াগুলো আমাকে মানসিক শক্তি জুগিয়েছিল। স্বামী পরিত্যক্তা তরুণীর মেয়ে নিয়ে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ সমাজে বাঁচাই ছিল প্রবল চ্যালেঞ্জের। তবু জীবন যুদ্ধে হার মানতে চাননি তিনি। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়েছেন ভারতের ‘নারীশক্তি’ বিজয়িনী সিন্ধু তাই আর ভার নিয়েছেন বহু সন্তানের| তাঁর নিজ হাতে তৈরী অনাথ আশ্রম, দুটি ছেলে ও দুটি মেয়েদের। তিনি ট্রেন গান গেয়ে, রাস্তায় ভিক্ষে করে একের পর এক অনাথ শিশুদের ভরণপোষণ করতেন। জীবনে কখনও কারও কাছে নিজের জন্য হাত পাতেননি। চাননি অর্থ কষ্ট করে হাসিমুখে হাজারের বেশি অনাথ শিশুদের মানুষ করেছেন তিনি। একটা সময় তাঁর থাকার কোনও জায়গা ছিল না। এমনকি তাঁকে কবর খানা, শ্মশানে অবধি থাকতে হয়| মহারাষ্ট্রের অরণ্যবাসীদের অধিকার নিয়েও আপসহীন লড়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই দীর্ঘদিনের লড়াইকে মান্যতা দিতে বাধ্য হয়েছিল মহারাষ্ট্র সরকার|
নাম টা শুনে নির্দিধায় বলে ফেলা যায় ইনি একজন মহিলা কিন্তু নামে কি আসে যায় | মায়ের কি আলাদা নাম থাকে| ইনি একজন ট্রান্সজেন্ডার, অবাক হলেন? হ্যাঁ তথাকথিত সভ্য সমাজে এদের কোনো অধিকার নেই বাঁচার, এরা না গর্ভে ধারণ করতে পারে সন্তান না হতে পারে কারোর পিতা, কোনঠাসা হয়ে এসেছে সারাজীবন| তবে গৌরী মা হয়েছে, টেনে নিয়েছে এক অনাথ মেয়েকে বুকে| সমাজের পাঁজর ভাঙতে পেরেছেন তিনি| তিনি বলেছেন, মা তো সবাই হতে পারে একটা বাবা মা হতে পারে, বোন মা হতে পারে, দাদা মা হতে পারে, মা একটা অনুভূতির নাম| ভোট নিয়ে উৎসাহ বাড়াতে এবং নাগরিকের সচেতনতায় তিনিই প্রথম ট্রান্সজেন্ডার যিনি ইলেকশন আম্বাসাডার| মুম্বাইয়ের ট্রান্সজেন্ডার এক্টিভিস্টদের মধ্যে অন্যতম মুখ গৌরী সাওয়ান্ত| ২০০১ সালে তিনি একটি এনজিও তৈরি করেন, মূলত যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য। এইডসে আক্রান্ত হয়ে যে সব যৌন কর্মীরা মারা যান তাঁদের সন্তানরাই ঠাঁই পায় তাঁর হোমে। গৌরী ২০০০ সালে সাক্ষী চর চৌগি নামক একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন, এই এনজিও নিরাপদ লিঙ্গ প্রচার করে ট্রান্সজেন্ডারদের| ২০১৪ সালে, তিনি প্রথম মহিলা যিনি ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার গ্রহণের জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করেন| তিনি জাতীয় আইনী সেবা কর্তৃপক্ষের (নালসা) মামলায় আবেদনকারী ছিলেন, যেখানে সুপ্রিম কোর্ট ট্রান্সজেন্ডারদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ২০১৭ সালে গায়ত্রীর মা এইডসে আক্রান্ত হওয়ার পরে গায়ত্রীকে দত্তক নেন। দুবছর আগে ভিক্সের একটি বিজ্ঞাপন শিরোনামে আসে| বিজ্ঞাপনটি ভিক্সের ‘টাচ অফ কেয়ার’ প্রচারের অংশ ছিল এবং সেখানে গৌরী এবং তাঁর মেয়ের গল্প দেখানো হয়েছিল |
নাহ, মানুষের না,ইনি গাছের মা, খুব অদ্ভুত তাই না? পরিবেশের অকাল ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আজ এই গাছ কাটার জন্য| সালুমারাদা থিম্মাক্কা, যিনি মারাদা তিমাক্কা নামেও পরিচিত, কর্ণাটক রাজ্যের একজন পরিবেশবিদ। হুলিকাল এবং কুদ্দুরের মধ্যে রাজপথের চার কিলোমিটার জায়গা বরাবর ৩৮৫টি অশ্বত্থ জাতীয় গাছ লাগিয়ে এবং তাদের যত্ন করে খবরের শিরোনামে আসেন| তিনি প্রায় ৮০০০ অন্যান্য গাছও লাগিয়েছেন। চরিত্রের দৃঢ়তা এবং সংকল্পের আর এক নাম তিনি। সন্তান ধারণ করতে পারেননি তিনি গর্ভে| ৪০ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন মা না হওয়ার অবসাদে| তারপর গাছকেই সন্তান হিসেবে বুকে আগলে ধরেন তিনি| স্বামীর সমর্থনে ও অনুপ্রেরণায় গাছ লাগাতে শুরু করেন তিনি| প্রথাগত কোন শিক্ষা পাননি কখনও, একটি খাদানে দৈনন্দিন শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর এই কাজকে জাতীয় নাগরিক সম্মান প্রদান করে স্বীকৃতি দেওয়া হয়| স্বীকৃতি স্বরূপ হিসেবে ভারত সরকার তাঁকে ২০১৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেন। লস অ্যাঞ্জেলেস এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড ভিত্তিক একটি মার্কিন পরিবেশ সংস্থা, থিম্মাক্কা রিসোর্সেস ফর এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন এর নামকরণ তাঁর নামে করা হয়েছে| তাঁর এই কাজের কারণে তাকে “সালুমারাদা” (কন্নড় ভাষায় গাছের সারি) নামে ডাকা হয়। ২০১৬ সালে, ব্রিটিশ সম্প্রচার কর্পোরেশন সালুমারাদা থিম্মাক্কাকে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণামূলক মহিলার মধ্যে একজন তালিকাভুক্ত করেছে। তাঁর ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে কত গাছ তাই মা এভাবেও হওয়া যায় | মায়ের অনুভূতি টাই আসল|
মা শব্দের বিশ্লেষণ হয়না, মায়ের কোনো বিশেষ দিন হয়না,দিন খুঁজতে গেলে সেটি হয়তো একটি অন্য বিতর্ক হয়ে যাবে| ক্যালেন্ডারের দিনক্ষণ মেনে আর যা-ই হোক অন্তত মাকে ভালোবাসা যায় না। তবু সারা পৃথিবীর মানুষ আজ গভীর মমতায় মাকে স্মরণ করবে। জগতে মায়ের মতো প্রিয় মানুষ হয়তো আর কেউ হতে পারেনা| প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মাতৃ দিবস পালন করা হয়, কিন্তু এটা ভীষণ আপেক্ষিক | মা র সন্তানের সম্পর্কে কোনো আপেক্ষিকতা থাকেনা | মাতৃত্ব একটা আস্বাদ যা সবকিছুকে ভালোবাসতে শেখায়, সবার মা হতে শেখায়| আজ বিশ্ব মা দিবস। পৃথিবীর সব মায়ের প্রতি রইল অনিঃশেষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। মা, তুমি ভালো থাকো… যত্নে থেকো, আদরে থেকো |
১০/০৫/২০২০
রিপোর্ট- রুমকি সরকার
চিত্র সূত্র- গুগল