‘চারুলতা’ a masterpiece of The Ray| রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায় | ‘নষ্টনীড়’ দিয়ে নয় বরং চারুলতাই ‘নষ্টনীড়’-র পরিচয় | সিনেমাটির অন্তর্নিহিত ও বাহ্যিক উপস্থাপনাই এই ছবির মূল শাখা-প্রশাখা| হয়তো বিশ্বকবিও গল্পটি লিখেছিলেন ‘চারুলতা’ তে চলচ্চিত্ররূপ দেওয়ার জন্য, কাল্পনিকভাবে সেটা মনে হলেও সিনেমাটি পর্দায় বাস্তবে দেখার সময় তাই মনে হতে বাধ্য | সত্যজিৎ রায় নামের পাশে ‘ভুল’ শব্দটি বড় বেমানান তবুও এই কাহিনীচিত্রটিকে অনেকেই মনে করেন তার পরিচালক জগতের সবচেয়ে ত্রুটিহীন একটি কাজ| সিনেমার জগতে থাকা বা দর্শকদের একাংশের ভাবনায় এই চলচ্চিত্রে চারুলতা নামের এক সঙ্গহীন গৃহবধুর কষ্ট ও জীবনের পরবর্তীকালে তার দেবরের প্রতি প্রেম, ভালোবাসার অনাবিল প্রশান্তি যা দহনকর হয়ে উঠেছিল, তা সত্যজিৎ রায় যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা বিদ্ধ করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অলংকৃত কাব্যময়তাকেও|
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘দ্য লোনলী ওয়াইফ’ নামক চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে চারুলতা সিনেমার প্রেক্ষাপট যার উপজীব্য ছিল দাম্পত্য সম্পর্ক ও প্রেম| চারুলতা সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালের আজকের দিন অর্থাৎ ১৭ এপ্রিল, তাই সিনেমার পাতা থেকে এই দিনটা উঠে এসে একটা নস্টালজিক ছোঁয়া দেয়, ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া বাংলা সিনেমার প্রতি প্রেম| সিনেমায় চারুলতার স্বামী ভূপতি ছিলেন তৎকালীন সময়ের উচ্চবিত্ত এক পরিবারের কর্তা, পেশায় আইনজীবী প্রচন্ড খেয়ালী একজন মানুষ | এই ভূমিকায় অভিনয় করেন শৈলেন মুখোপাধ্যায় | পর্দায় এত সাবলীল অভিনয় খুব কমই দেখা যায় এ ধরনের দৃঢ় চরিত্রে| এনার চরিত্র নিয়ে বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হয় রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার সম্পন্ন এক ব্যক্তি যার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল তার বাড়িতে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক ইংরেজি পত্রিকার অফিস| তাই বলে কি তিনি তাঁর স্ত্রী চারুলতার প্রতি কি আদৌ উদাসীন ছিলেন?
চারুলতা ও ভূপতি
চিরাচরিতভাবে দেখতে গেলে যদি তিনি চারুলতার প্রতি উদাসী মনোভাবের ছিলেন তাহলে চারুলতার ভাই উমাপতিকেই বা কেন তিনি নিয়ে আসবেন? শুধু কি নিজের কাজের সুবিধার্থে নাকি উমাপতির বউ মন্দাকিনীর উপস্থিতি কি আদতে চারুর নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য নয়? প্রশ্নটা বড্ড প্রাসঙ্গিক| এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে অনবদ্য চরিত্র হচ্ছে চারুলতা, নামের সার্থকতায় চরিত্রটিও বেড়ে উঠেছে ক্রমশ, ছাড়িয়ে গেছে নিজেকেই | একটি প্রাণবন্ত কিশোরী চরিত্র, যে আড়ালে থেকেই পরিচয় আত্মস্থ করেছে সর্বদা| মাধবী মুখোপাধ্যায় চারুর চরিত্রে নিজেকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন জলছবির মতন, তাই তাঁর অভিনয় দক্ষতা সম্পর্কে কিছু বলা খুবই অপ্রাসঙ্গিক| তারপরে আসা যাক চারুলতার দেওর অমলের চরিত্রে কথায়, যাকে ঘিরে বদলাতে থাকে গল্পের মোড় |
চারুলতা ও অমল
অসাধারণ প্রতিভাবান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন এই চরিত্রে, উনি ছাড়া এই চরিত্রে রূপদান আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না| তিনি এক আবেগী ছেলে মানুষের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন একেকটা দৃশ্যের খাঁজে খাঁজে| চারুলতা তার বৌঠান, যার প্রতি প্রথমদিকে ছিল এক অত্যন্ত স্নেহশীল ভালোবাসা, যার ফলে ভূপতি তার দাদা তাকে দায়িত্ব দেয় তার বৌঠানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচন করার|
চারুর সাথে অমলের সম্পর্কটা প্রথমদিকে বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও ধীরে ধীরে এই বন্ধুত্বপূর্ণ ছেলেমানুষি ছেলেটিই হয়ে ওঠে চারুলতার মনের প্রকৃষ্টতার কারণ, অমল তা বুঝতে পারলে তার দাদার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে বুঝতে পেরে রাতের বেলায় একটি চিঠি রেখে চলে যায়| সাময়িকভাবে অমলের চরিত্রের ছেলেমানুষির দিকগুলো ফুটে উঠলেও তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রশংসনীয়| বিয়ে করলে বিলেত নিয়ে যাবে এমন লোভনীয় সুযোগও হেলায় ছেড়ে দিয়েছিল সে। মন্দাকিনী চরিত্রটি সবচেয়ে সহজ এবং সাবলীল চরিত্র যার মধ্যে কোনো লুকোছাপাই নেই| অমলকে ভাল লাগাও যেমন সহজে প্রকাশ্য, তেমনি চারুর সাথের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বটাও | অমলের ভাষায় মন্দাকিনী প্রবীণার চর্চা করে আর চারু করে নবীনার। অমলের প্রতি চারুর ভালবাসা ছিল এটা বেশ বোঝা যায়, যদিও কেন জানি মনে হয় শুরুটা বাৎসল্য দিয়েই হয়েছিল। নিজে লেখালেখি শুরু করার পেছনে ছিল আবেগ, যা পূর্ণতা পায় অমলের দৌলতে|
মাধবী মুখোপাধ্যায় ও সত্যজিত রায়
সত্যজিৎ রায় ‘চারুলতা’ কে তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাখতেন | এই ছবির মূল ভাব তার অন্যান্য ছবির ধরন থেকে আলাদা | এই ছবিতে মনন সম্পর্ক, মানসিক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও প্রেম, স্বকীয়তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চর্চা করেছেন তিনি| তাঁর রবীন্দ্র প্রীতিও প্রবল ভাবে লক্ষণীয় এ ছবিতে| এর আগে তিন কন্যায় প্রথম তিনি রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে কাজ করেছিলেন| বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ছবিটি নিবিড় ও স্বাধীন ব্যক্তি সম্পর্কের এক প্রাসঙ্গিক উদাহরণ | অন্যদিকে ক্যামেরার সুকৌশল কারুকার্য পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছে চারুলতার একাকীত্ব এবং অন্দরমহলে নারীদের বিস্মৃতির ছবি| জানলার লোহার পারদ, দূরবীন দিয়ে বাহির দেখা, খাঁচার মধ্যে বন্দি পাখি, হাতের কাজে সূতো দিয়ে নকশা করা এই সবকিছু নিয়েও ফুটে উঠেছে চারুলতা অভ্যন্তরীণ জীবন| ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে জায়গা পায় | প্রসঙ্গত বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবেও এই ছবি সিলভার বেয়ার পুরস্কার পায়| দেশের বাইরে এই চলচ্চিত্র নিয়ে একটা অন্য মাত্রার উচ্ছাস থাকলেও নিজের দেশেই ‘চারুলতা’ চিত্রনাট্য নিয়ে বিতর্কের সম্মুখীন হন সত্যজিৎ রায়| বেশ কিছু সমালোচক ছবিটিকে মূল গল্প ‘নষ্টনীড়’ এর সাথে বেশ কিছু জায়গায় অমিল পাওয়ায় অভিযোগ তোলেন | অবশ্য এই ছবির সাফল্য ও দৃষ্টিভঙ্গিই যোগ্য জবাব দেয় সমালোচকদের| সিনেমার ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে এরকম মধুর স্মৃতি বারবার বাংলা সিনেমাজগতের পথকে প্রশস্ত করে, স্বাধীন ও দৃঢ় হতে ভাবায়| বাংলা চলচ্চিত্র জগতের শ্রেষ্ঠ উপমার উদাহরণ দিতে গেলে ‘সত্যজিৎ রায়’ নামটার যথার্থতা ব্যাখ্যা করার মতন কোনো ধৃষ্টতা বা সাহস সচরাচর দেখানো যায় না কারণ এই নামটাই একটা ব্র্যান্ড যার সাথে বাঙালির সিনেমার প্রতি আবেগ, শিহরণ, প্রেম বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, যেন ঠিক পুরনো চাল ভাতে বাড়ে | সত্যজিৎ রায় এক বাঙালি কিংবদন্তি বা বলা যায় বাংলা সিনেমার প্রাণপুরুষ যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিশ্বদরবারে| বাংলা ছবির নাম শুনলেই বাঙালিরা হ্যাংলার মতন বলে ওঠেন ‘ওই যে সত্যজিৎ রায় একমাত্র বাঙালি অস্কারজয়ী’ তা সে ভেতো বাঙালি হোক বা মনোটোনাশ বাঙালিই হোক না কেন তখন তাদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে ইনসাইক্লোপিডিয়া ঘাটা জ্ঞানী বাঙালি| সত্যজিৎ রায় বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে একটা বাঁধিয়ে রাখার মতন পরিচয় দেন সারা বিশ্বের কাছে| ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী সিনেমা দিয়ে তিনি রূপালি পর্দার জগতে পরিচালক হিসেবে পদার্পণ করেন| সবমিলিয়ে মোট ৩৬টি সিনেমা তিনি পরিচালনা করেছিলেন, এর মধ্যে তথ্যচিত্র ও শর্টফিল্ম ছিল | তার সেরা সিনেমা গুলির মধ্যে অন্যতম হলো অপুর ট্রিলজি, চারুলতা, মহানগর, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, হীরক রাজার দেশে, ঘরে- বাইরে, পরশপাথর, নায়ক ইত্যাদি| যা আজও বর্তমানের সুপার হিট ছবির সামনে বাংলার বাঙালির ভালোবাসা, আবেগ গর্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৭/০৪/২০২০ রুমকি সরকার চিত্র সূত্র – গুগল