কলকাতা: ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা…’ যুগ-যুগান্তর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও, -‘বনমালী’দের আর ‘রাধা’ হওয়া হয় না। দিনের পর দিন নারীত্ব আপনের তীব্র বাসনাতেও, শতসহস্র ‘বনমালী’র শারীরিক রাধা হয়ে ওঠা হয় না আর। ভালোবাসার পবিত্র সূত্রকে আপন করেও, সব মানুষের মতো, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আকাঙ্খার মধ্যেও, হারিয়ে যেতে হয় সমাজের আক্রমণাত্মক লোলুপতার কাছে। শিকার হতে হয় অনেকটা ‘না ভালো’ থাকার। তবুও এগিয়ে যান কেউ কেউ। জীবনের সমস্ত ‘বাধা’ কাটিয়ে, দিনের পর দিন এগিয়ে যেতে থাকেন ‘কন্টকময়’ পথেই।
প্রবাসী বাঙালি নীলও এগিয়ে চলেছেন এইভাবেই। ভারতের সংস্কৃতি থেকে শতযোজন দূরে থেকেও, আজও বলে চলেছেন নিজের লড়াইয়ের কথা। নিজের ভালো অথবা বেশি বেশি ‘মন্দ’ থাকার কথা।
কলকাতার নীল (বিপ্লব) চট্টোপাধ্যায় ইসরায়েল থাকেন। গবেষণা-কর্মসূত্রে তাঁর বসবাস, প্রবাসেই। এই নীলের জীবন নিয়েই তৈরি হয়েছে একটি তথ্যচিত্র। ”সত্তা- দ্য এন্টিটি”, যা ইতিমধ্যেই নির্বাচিত হয়েছে, ২০২০-এর ‘লিফ্ট অফ্ গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’-এ।
আসলে, সমকামী মানুষের জীবন নিয়ে একাধিকবার অনেককিছু প্রকাশ্যে এলেও, রূপসা ঘোষাল আর বিট্টু রায় চৌধুরীর পরিচালনায় এই তথ্যচিত্রটি কিন্তু অভিনব। এই তথ্যচিত্রে, মূলত, নীল তুলে ধরেছেন তাঁর সমকামী-জীবনকাহিনী। ভালথাকার কথা। মন্দ থাকার কথা। নিজের গতিপথের চরাই-উতরাইয়ের কথা বলেছেন তিনি। একজন পরিণত মানুষের জীবনে,
যা যা থাকে, তার পাশাপাশি, সামগ্রিক জীবনযুদ্ধের কথা বর্ণনা করেছেন সমকামী এই অভিনেতা।
মূলত, রূপসা-বিট্টু নির্মিত এই তথ্যচিত্র, গতানুগতিক ধারার থেকে খানিকটা আলাদা। অনেকের মতে, বেশ মৌলিক। কারণ হিসেবে সিনেমা মহলের একাংশের মত: তাঁরা একেবারে সাধারণভাবে, নীলের মতো একজন সমপ্রেমে বিশ্বাসী মানুষের কথাই শুধু বলেননি, এই কাহিনী বর্ণনের মধ্যেই রয়েছে বিভিন্ন অভিনবত্ব।
কাহিনী এবং তাঁর উপস্থাপনের সঙ্গে সংযোগস্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের। মূলত চারটি রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার এবং তার সঙ্গে নীলের জীবনের বিভিন্ন পর্বের যোগসূত্র স্থাপনে নজর দিয়েছেন পরিচালক-দ্বয়। কখনও, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল’ অথবা ‘গোপন কথাটি’ ব্যবহার, কখনওবা ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি,’ ‘তোমায় গান শোনাবোর’ -মত গানের ব্যবহার করা হয়েছে এই নির্মাণে। সমস্ত গানের ব্যবস্থাপনা, নেপথ্যসঙ্গীত সবটাই করেছে ‘বুদ্ধায়ন’ নামে একটি বাংলা-ব্যান্ড। এখানেও রয়েছে অভিনবত্ব, বাংলা ছবি বা তথ্যচিত্রের জগতে, একটি ব্যান্ডের সম্মিলিত কাজ অনেকাংশেই বিরল।
এই কাজ ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে দেশজুড়ে। ৩৭৭ ধারা অবলুপ্তির পর, ভারতীয় সমকামীদের জীবন নিয়ে বিভিন্ন কাজ, সম্প্রতি একটি হিন্দি সিনেমা জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও, এই তথ্যচিত্র সকলের থেকেই খানিকটা অন্যরকম বলে মনে হচ্ছে সিনেমাপ্রেমীদের একাংশের। বুদ্ধায়ন প্রযোজিত, এই কাজটি দেখতেও উৎসুক তাঁরা।
কেন? কেন দেখবেন ? কেন নীলের জীবনকথা শুনতে চাইবেন দর্শক?- উত্তর দিলেন পরিচালক নিজেই। রূপসা জানালেন তাঁদের ‘ইউএসপি’র কথা। তিনি জানান, “এই ছবির মধ্যেই দুজন পরিচালকের মতামত রয়েছে। সেটাও আমাদের তৈরি তথ্যচিত্রের একটা অংশ। সবটাই তৈরি হয়েছে মূলত ‘ফ্রীস্টাইলে’। চিরাচরিত ‘টেকনিক্যাল’ ধারণা থেকে বেরিয়ে। মূলত, এখানে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে আমরা ‘ফ্রীস্টাইল’ পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। কোনও নির্দিষ্ট নিয়মের প্রয়োগ করিনি।” রূপসা আরও বলেন, “ইরানি ছবি আমাদের খুব উদ্বুদ্ধ করেছে। জাফর পানাহির কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি আমরা। যা বাংলায় খুব কম। মূলত,এখানে ক্যামেরার মধ্যে ক্যামেরা, অর্থাৎ একটি ক্যামেরার ফ্রেমেই আরেকটি ক্যামেরার উপস্থিতি। এই বিষয়টা রয়েছে। যা নতুন।”
প্রসঙ্গত, বাংলা ছবির জগতে এই ‘ক্যামেরা উইদিন ক্যামেরা’র বিষয়টি বেশ অভিনব। একটি ‘সিন’ যখন প্রতিফলিত হচ্ছে দর্শকের সামনে, তিনি সেই ফ্রেমেই দেখতে পাচ্ছেন দ্বিতীয় ক্যামেরাটিকে। যা সাম্প্রতিক বাংলা ছবি বা তথ্যচিত্রের ইতিহাসে খুব কম পরিলক্ষিত হয়। এই প্রসঙ্গে ওই পরিচালক বললেন, “আমরা নিজেদের মতো করে চেষ্টা করছি একদম অন্যরকমভাবে, একদম সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার। ভাবনা চিন্তাটা হয়তো চিরাচরিত সিনেমা তৈরির ধারণা থেকে খানিকটা আলাদা। আমরা আরও ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ কাজ করতে চাই আবার।”
প্রসঙ্গত, অভিনেতা নীলের সঙ্গে নির্মাতাদের আলাপ কলকাতার ‘প্রাইড ওয়াক’ থেকে। তারপর থেকে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। ভালো গান জানা, নীলকে দিয়ে গানও রেকর্ড করান তাঁরা। আলাপ জমতে থাকে ক্রমশ। ইসরায়েল থেকে ফিরতেই শুরু হয় শ্যুটিং। অবশেষে বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিচ্ছে এই সৃষ্টি। ‘সত্তা’কে প্রকাশিত করছে বারবার। মানবিক সত্তার আবেদনে মুখরিত হচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশও। ‘সত্তা’র মোহে আকৃষ্ট বাংলার একাংশের দর্শকমহলও। শুধু অপেক্ষা, এই কাজটি দেখতে পাওয়ার। নীলের ‘সত্তা’কে আপন করে নেওয়ার।
আদতে, জীবনের মৌলিক সমস্ত চাহিদার মতোই, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন নীলের মতো চাহিদারা। তাঁরাও বলতে চান মনের কথা। এগিয়ে নিয়ে যেতে চান কন্টকহীন জীবনকে। আর বিবিধের মাঝে মিলিত হতে চান বারবার। কিন্তু সামাজিক কিছু ত্রুটিবিচ্যুতির ভুক্তভোগী হয়ে, দিশা খুঁজতে অগ্রসর হতে হয় ক্রমশ। কিছু অতিমানবীয় সত্তার কুরুচির কারণে আবদ্ধতায় জড়িয়ে যায় নীল’দের প্রকাশ্য সত্তাও। তবুও লড়ে চলেন। তবুও শুভ মঙ্গলের আশায় এগিয়ে যান ওঁরা। এগিয়ে যান, তাঁদের ভালোলাগা আর ভালোথাকাকে সঙ্গী করেই, যেখানে সহযোগী ভূমিকা পালন করেন রূপসা, বিট্টুর মতো পরিচালকেরা। যাঁদের হাত ধরেই শতসহস্রের মাঝেও ধ্বনিত হয় নীলদের ‘সত্তা’র কথা।
কলকাতা
ছবি সৌজন্যে: রূপসা ঘোষাল, নীল চট্টোপাধ্যায়।
রিপোর্ট: রমেন দাস