বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি: ইতিহাস, বর্তমান এবং একটি প্রসঙ্গ..।

“বুদ্ধ পূর্ণিমা” বা বৈশাখী পূর্ণিমা হল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্রতম উৎসব। এই পুণ্য উৎসব বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হয়। বৈশাখী পূর্ণিমা দিনটি বুদ্ধদেবের তিন স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন হিসেবে মানা হয়। সেই তিন স্মৃতি হল — ৬২৩ খৃষ্টপূর্বাব্দে এই পবিত্র তিথিতে বুদ্ধদেব জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ৫৮৮ খৃষ্টপূর্বাব্দে বোধি বা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন এবং সর্বোপরি ৫৪৩ খৃষ্টপূর্বাব্দে মহাপরিনির্বাণ বা মোক্ষ লাভ করেছিলেন। এবার আমরা তাঁর জন্ম ইতিহাস আলোচনা করলে পাবো ৬২৩ খৃষ্টপূর্বাব্দে লুম্বিনী নগরের কপিলাবস্তু শহরের রাজা শুদ্ধোদন ও রাণী মায়াদেবী এর কোল আলো করে এক কাননের শালবৃক্ষ ছায়ায় উন্মুক্ত আকাশতলে জন্ম হয়েছিল তাঁর। তাঁর নিকট জাতি, শ্রেণি ও গোত্রের কোনো ভেদাভেদ ছিল না।

তিনি মানুষকে মানুষ এবং প্রাণীকে প্রানীরূপেই জানতেন এবং সব প্রাণসত্তার মধ্যেই যে প্রাণ আছে, কষ্টবোধ আছে তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। তাই তিনি বলেছিলেন — ‘সবেব সত্তা ভবন্তু সুখীতত্ত্ব’। অর্থাৎ জগতের সব প্রাণী সুখী হোক। এই মর্মচেতনা জাগ্রত করার জন্য এবং এই পরম সত্য জানার জন্য তিনি ২৯ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন। সত্যের সন্ধানে পরিভ্রমণ করতে করতে এক সময় তিনি গয়ার উরুবেলায় (বুদ্ধগয়া) গিয়ে নিবিষ্টচিত্তে সাধনামগ্ন হন। দীর্ঘ ছয় বছর অবিরাম সাধনায় তিনি ৫৮৮ খৃষ্টপূর্বাব্দে, সম্যক সম্বুদ্ধ বা বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। সেদিনও ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।

বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধদেব জীবের মুক্তি কামনায় ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ নামে জীবনের সর্ববিধ ক্লেশ থেকে মুক্তির উপায় আবিষ্কার করেন। তিনি “চতুরার্যসত্য” নামে খ্যাত এক তত্ত্বে জীবনে দুঃখের উৎপত্তি ও দুঃখভোগের কারণ, দুঃখ ভোগ এবং দুঃখ থেকে মুক্তির মার্গ নির্দেশ করেন। মুক্তির এই পথনির্দেশনাকে বলা হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। আমরা প্রত্যেকেই ছোটবেলায় সেই অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে পড়েছিলাম। চলুন আরেকবার দেখি কি ছিল সেই আটটি পথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গ। সেগুলি হলো —

১. সম্যক দৃষ্টি
২. সম্যক সঙ্কল্প
৩. সম্যক বাক্য
৪. সম্যক কর্ম
৫. সম্যক শিক্ষা
৬. সম্যক প্রযত্ন
৭. সম্যক স্মৃতি
৮. সম্যক সমাধি

বৈশাখ মাসের এই পূর্ণিমা দিবসে মহামানব বুদ্ধদেবের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে দিনটি ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ নামে খ্যাত। সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্বলাভের মধ্য দিয়েই জগতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়। এই দিনে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ স্নান করে, শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে মন্দিরে “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি” “ধম্মং শরণং গচ্ছামি,” “সংঘং শরণং গচ্ছামি” অর্থাৎ যার আক্ষরিক মানে করলে দাঁড়ায় আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম, আমি ধর্মের শরণাগত হলাম, আর আমি সংঘের শরণাগত হলাম। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কি তাই? আসলে বুদ্ধদেব কি বোঝাতে চাইলেন এই তিন মন্ত্রের মাধ্যমে?

বর্তমান ভারতবর্ষের যা পরিস্থিতি তাতেও কিন্তু লক্ষ্য করলে এই তিনটি বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। অর্থাৎ “আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম” মানে এই নয় আমি বুদ্ধদেবের শরণ নিলাম, ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে তিনি বলছেন, আমাদের বৌদ্ধিক সত্তার শরণাগত হওয়া মানে আমাদের নিজেদের বুদ্ধিবলে, চেতনাবলে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তার বিচার করতে শেখাচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, “আমি ধর্মের শরণাগত হলাম” মানে কোন ধর্ম? মানবধর্ম। অর্থাৎ মানুষের কল্যাণের জন্য যা শ্রেয়, সেটাই সবার পালন করা উচিত। তৃতীয়ত, “আমি সংঘের শরণাগত হলাম” অর্থাৎ কোন মন্দির মসজিদ গীর্জায় গিয়ে খোল করতাল নিয়ে হরিবোল নামগান করা, নামাজ পড়া, প্রেয়ার করা নয়। মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একত্রিত হওয়া, জোটবদ্ধ করে তাঁদের লড়তে শেখানোটাই হল একজন প্রকৃত রাজার কাজ। দেশ যখন বিপর্যয়ের মুখে তখন সকলের একত্রিত হওয়ার প্রয়োজন আছে, এটা বোঝানোই একজন রাজা বা শিক্ষাগুরুর কাজ। কারণ, তিনিও একজন রাজার পুত্র। কাজেই দেশ আর দশের খেয়াল রাখাটা তো তাঁর কর্তব্য।

আর সেটাই তিনি তাঁর তিনটি বানীর মধ্যে দিয়ে আমাদের বুঝিয়েছিলেন। যাই হোক, সবশেষে একটাই কথা বলার, যুগে যুগে এইভাবেই ভগবান নানা অবতারে এসে আমাদের সচেতন করেছেন। শুধুমাত্র আমাদের বোধগম্যতার অভাবে আমরা তা বুঝতে পারিনা। আশা রাখি আগামী ভবিষ্যতে আমরা বর্তমান জ্বালা যন্তন্না থেকে খুব শিরগিরি মুক্তি পাব। সর্বোপরি আমাদের দেশে যখন এত ভগবানের অবতারে আগমন ঘটেছে, তাঁদের মার্গদর্শন আমাদের পাথেয় হয়ে উঠুক এই কামনা করি। সকলে ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।

বুদ্ধপূর্ণিমা, ২০২০
০৭.০৫.২০২০
লেখা: জয়সূর্য ঘোষ