শত বছরে একটি করে মারণ মহামারী, যা বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইতিহাস সাক্ষী আছে।ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করলে দেখলে দেখা যাবে,১০০ বছর অন্তর মহামারিঃপ্লেগ(১৭২০),কলেরা(১৮২০),স্প্যানিশ ফ্লু(১৯২০)।একইরকম বিশের করোনা ভাইরাস।মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক একটি মহামারির কবলে পড়েছে সারা বিশ্ব।মানুষের জীবন বারবার বারবার এই ছোট্ট ভাইরাস যা দানবের আকারে এসে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
১.প্লেগঃYersenia pestis নাকক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত এই ভাইরাস যা ১৩৪৭ সালে প্রথম সংক্রমণ ঘটে।এই রোগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ সংলগ্ন কিছু এলাকায়। ১৭২০ সালে সর্বশেষ যে বুবোনিক প্লেগের সংক্রমণ ঘটে সেটি বৃহৎ আকারের মহামারী রুপ ধারণ করে। এটিকে মার্সেইয়ের দুর্দান্ত প্লেগও বলা হয়। রেকর্ডগুলি দেখায় যে ব্যাক্টেরিয়া মার্সেইলে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা গেছিলো । ধারণা করা হয় যে এই ব্যাক্টেরিয়া সংক্রামিত মাছি দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে।
এক সময় অনেকেই বিশ্বাস করত যে সিন্ধু নদীর পূর্বাঞ্চলে প্লেগ কখনও দেখা দেয় না। কিন্তু উনিশ শতকে ভারতের একাধিক জেলায় এ রোগের আর্বিভাব ঘটে। প্রায় তিন বছর প্রচন্ড দুর্ভিক্ষের পর ১৮১৫ সালে গুজরাট, কাথিওয়ার এবং কুচ এলাকায় প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। বছর ঘুরতেই এলাকাগুলিতে এ রোগ আবার আঘাত হানে এবং ক্রমে তা সিন্ধু প্রদেশ ও হায়দরাবাদসহ দক্ষিণ-পূর্বে আহমাদাবাদ ও ধলেরা শহরে এই রোগ বিস্তৃতি লাভ করে। পরে এসব এলাকা ছাড়া ভারতের আরও কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়লেও এই রোগ মহামারির আকার নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একপর্যায়ে রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে সব অসুস্থ লোকের বাড়িতে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। মৃতদের লাশ জোর করে কবরে দাফন করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এসব পদক্ষেপেই একসময় এই ভয়ংকর প্লেগ পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে দূর হয়েছিল।
২.কলেরাঃ১৮২০ সালে সর্বপ্রথম ছড়িয়ে পড়ে ইন্দোনেশিয়াতে।ভিব্রিও কলেরি নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। যার প্রধান উপসর্গ মারাত্মক উদরাময়, মুহূর্মহু প্রচুর জলের মত পাতলা পায়খানা, সঙ্গে পেটব্যথা, জলাভাবে এবং চিকিৎসা না হলে শেষপর্যন্ত দেহে জলাভাবের ফলে মৃত্যু। মানব শরীরে সংক্রমণের প্রধান বাহক পানীয় জল অথবা খাদ্য।১৮২০ সালে এই জীবাণুটির কারণে এশিয়ায় ১ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড করা হয়েছিল। ১৮২০ সালের মহামারী এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ফিলিপাইন, ভারত সহ নানা অংশে নদীর জল খাওয়ার কারণে শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়।
২০ সালে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কলেরায় আক্রান্ত এলাকার দৃশ্য ছিল একেবারেই ভিন্ন। এশিয়াটিক কলেরা নামে পরিচিত এই অতি মহামারি শুরু হয় কলকাতার ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে। পরে তা প্রায় অর্ধেক বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এই মহামারিতে কত লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল সঠিকভাবে না জানা গেলেও সঠিকভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ নিরাময় করা হয়েছিল।
৩.স্প্যানিস ফ্লুঃ অর্থোমিক্সোভিরিডি (Orthomyxoviridae) পরিবারের একটি ভাইরাস, যা ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের জন্য দায়ী। বিভিন্ন সময়ে এটা লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে।স্প্যানিশ ফ্লু নামে নতুন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ কানসাসের আমেরিকান সেনা সদস্যদের মধ্যে। পরে ঝড়ের গতিতে ছড়াতে শুরু করলো সেই জ্বর। সারা পৃথিবীকে গ্রাস করতে চাইল এই মরণব্যাধি। পরের দুই বছরে সারা পৃথিবীতে প্রাণহানি হয় কমপক্ষে ৫ কোটি মানুষের।
এই ১০০ বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লু জিনগত ভাবে পরিবর্তন হতো,যার ফলে বেশ ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। এই মহামারি বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ছিল।এই ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগের জন্য লড়াই করার জন্য কিছু অ্যান্টিবায়োটিক তৈরী হয়,যা এই রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে।
সার্স -কোভ২- যা চিনা ভাইরাস নামে পরিচিত।এই ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ হয়,২০১৯ এর ১ডিসেম্বর, যা ধীরে ধীরে সংক্রামিত হয়ে পুরো পৃথিবীতে জাঁকিয়ে বসেছে।চিন থেকে উদ্ভুত এই ভাইরাসে এখনও পর্যন্ত বিশ্বের লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত,মৃতের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে।
জ্বর সর্দি, কাশি,মাথা ব্যাথা দিয়ে রোগের বিস্তার।এই রোগ কারোর সংস্পর্শে এলে সাথে সাথে সংক্রামিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।যদি কারোর এই রোগ ধরা পড়ে,তার আশেপাশের সকলকে ১৪ দিনের কোয়েন্টারটিনে পাঠিয়ে চিকিৎসাধীনে রাখা হচ্ছে।
এই রোগের সঠিক অ্যান্টিবডি না বেরালেও ভারতের হাইড্রক্সিক্লুরোকুইন যা ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক, তাই দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে।করোনার জেরে বিশ্বে লকডাউন আজ।মানুষ ঘরে থেকে এই রোগের সাথে মোকাবিলা করছে।পাশ্চাত্য দেশে হ্যান্ডশেক করতে এখন মানুষ ভয় পায়, তাই ভারতীয় পদ্ধতিতে নমস্কার করতে হচ্ছে আজ মানুষকে।
একদিকে সার্স কোভিডে যেমন মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন। তেমনই অপর দিকে প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে প্রকৃতি। পৃথিবী যেন নিজেকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে। হয়তো বুঝিয়েও দিচ্ছে তার ইচ্ছার কাছে মনুষ্যশক্তি কতটা দুর্বল।
রিপোর্ট – অর্পিতা বসু
চিত্র ও তথ্য সূত্র – গুগল