‘প্রসঙ্গ’ সত্যজিৎ: ধন্য শ্রমিকের দান, হীরকের রাজা ভগবান?

“হীরক রাজার দেশে”, সিনেমাটার নাম শুনলে প্রথমেই কী মাথায় আসে? ছোটদের ছবি? রাজনৈতিক রূপকধর্মী চলচ্চিত্র? যাকে আমরা পলিটিকাল স্যাটায়ার বলি, নাকি মিউজিক্যাল কমেডি?না, এই ছবির জঁর এত সহজে এক কথায় হয়তো বলে দেওয়া যায় না। বহুস্তরীয় চলচ্চিত্র নির্মাণ সত্যজিৎ রায়ের সিগনেচার মার্ক হলেও, মধ্যবিত্ত সুখী ড্রইংরুমের বাইরে গিয়ে, পলিটিক্যাল ডিপ্লোমেসি ছেড়ে, শৈশবের সারল্যের সাথে প্রাপ্তমনস্ক আদর্শবোধের মেলবন্ধনে, চেনা ছকের মধ্যে থেকে এক অচেনা সত্যজিৎ’র সাক্ষাৎ পাই আমরা হীরক রাজার দেশে। বয়সের সাথে সাথে, সময়ের বিবর্তনে, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আশু পরিবর্তনেও যেই ছবি একইভাবে প্রাসঙ্গিক এবং সমসাময়িক, সেই ছবি আদোতে একটা কল্পিত বাস্তব আর বাস্তবিক কল্পনার রূপকার্থের মাঝবরাবার দাঁড়িয়ে জিতে যাওয়া এক লড়াইয়ের খতিয়ান রচনা করে দিয়ে যায়।

“কী জানো হীরক রাজার প্রসঙ্গে?” -গুপি-বাঘা কে (তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ)উদ্দেশ্য করে উদয়ন পন্ডিতের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) করা এই প্রশ্নের উত্তর তিনি স্বয়ং দেন, এযেন ছবির ন্যারেটিভ কে আরো সহজ করে গল্পের ছলে সব বয়সী দর্শকদের কাছে পৌঁছে যাবার চেষ্টা এক অব্যর্থ প্রচেষ্টা। হীরক রাজের স্বৈরাচারী শাসন, খনি মজুরদের রক্ত জল করা পরিশ্রমের মাথায় বসে বিলাসব্যসন, কৃষকদের ওপর রাজকরের বোঝা চাপিয়ে দেয়া, স্বাধীন সঙ্গীতশিল্পীর কন্ঠরোধ, পাঠশালা বন্ধ করে ছাত্রদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা, বিদেশী অথিতিদের কাছে রাজ্যের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে বস্তি উচ্ছেদ, বিরোধী জনমতকে মগজ ধোলাই দিয়ে “এক মত এক পথ” এ নিয়ে আসার এক সরলরৈখিক গল্প রূপকথার ছলে, ছন্দের বাঁধুনি দিয়ে, গানের নিটোল বুনিয়াদি আঙ্গিকে ছবিতে উঠে আসে। আর এই সমস্ত শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসাবে উঠে আসে উদয়ন পন্ডিতের নেতৃত্বে গুপিবাঘার লড়াই জিতে নেওয়ার কাহিনী।

‘গুপিবাঘা’ সিরিজের দ্বিতীয় ছবি হিসাবে, হীরক রাজার দেশে, তে যেভাবে শাসক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব নিয়ে এক নিদারুণ টেনশন তৈরী করে হয়েছে ছবি জুড়ে, তা বিশেষভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৮০ তে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে সামাজিক স্তরবিন্যাস তথা শ্রেণিগত বিভাজন স্পষ্ট করে বুঝিয়ে তোলার জন্য রাজসভায় যখন এক এক করে কৃষক, সঙ্গীতশিল্পী, হীরার খনির মজুরের আবির্ভাব ঘটে, ছন্দবন্ধ, হাস্যরসে ভরপুর ডায়লগের মধ্যে দিয়েও উঠে আসে, শ্রমিকের শ্রম শোষণের বঞ্চনার ইতিবৃতান্ত, অর্থনৈতিক পুঁজি কুক্ষিগত করার ঘৃণা ষড়যন্ত্র! হায়! কী ভয়ংকর রাজতন্ত্র! যা সমান ভাবে প্রযোজ্য এখনকার গণতন্ত্রে ও! থাক, সেসব কথা।

ছবির প্রসঙ্গে আসি, প্রথমত,সত্যজিতের ছবিতে অবধারিত ভাবেই সেট ডিজাইন একটা বড়ো ভূমিকা রাখে, যে মানুষটা প্রত্যেকটা চরিত্রের যেভাবে ইলাস্ট্রেশন করে রাখতেন তার কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশিত। রাজসভা থেকে বৈজ্ঞানিকের কক্ষ সবক্ষেত্রেই রুচিশীল নান্দনিকতার ছাপ স্পষ্ট।

দ্বিতীয়ত, ক্যামেরার কাজ, রাজার কে ধরার সময় যেভাবে লো অ্যাঙ্গেল শট ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে দৃশ্যগত ও ভাবগত ভাবে চরিত্রের চারিত্রিক রূঢ়তাকে আরো দৃড় করে তোলে, আবার একই ভাবে মূর্তির মাঠে, ছাত্রদের সাথে উদয়ন পন্ডিতের ছুটে আসার দৃশ্যে লো অ্যাঙ্গেল শট নেওয়া হয়েছে, ক্লাইম্যাক্সে প্রোটাগনিস্টের “হিরোইক” চরিত্রায়ন ঘটাতে।

তৃতীয়ত, রাজা হিসাবে উৎপল দত্তের অভিনয়, থিয়েটারে রাজা নিয়ে যেকটি রূপকল্প তৈরী হয়ছিল, হীরক রাজা তার মধ্যে অন্যতম, ছবি দেখতে দেখতে থিয়েটারের সাথে চলচ্চিত্রের এক নিদারূণ মেলবন্ধন খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে দর্শকদের।

চতুর্থত, ছবির গান, যেই গান ই হয়ে ওঠে ছবির একটি বিকল্প কিংবা প্যারালাল ন্যারেটিভ। “রাজা অনাচারের সীমা ছেড়ে, অভাগারে ভাতে মেরে আনে দেশে ঘোর অমঙ্গল”- ক্লাইম্যাক্সে তো আর কোন তথাকথিত ডায়লগের প্রয়োজন পরে না, গানটুকুই যথেষ্ট। সিনেমার ভিজ্যুয়াল লিটরেসিই শেষ কথা বলে এখানে।

তবে ছোটদের ছবি হলেও এই ছবিতে টুকরো টুকরো করে শিশুদের দৃশ্যকল্প এসেছে, মূর্তি উন্মোচনের দিন যেই ছেলেটি গুলতি দিয়ে রাজার নাক ফাটিয়ে দেবার সাহস রাখে, তার ওপর আর পরবর্তীতে ফোকাস করা হয়না, নীরেন্দ্রনাথের কবিতার সেই “সরল শিশুটি” সত্যজিতের ছবিতে দেখা দিয়েই মিলিয়ে দেয়, “যে ছাত্রদল যত বেশী জানে তত কম মানে”, সেই ছাত্রদল কেনো এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিল না? যেখানে উদয়ন পন্ডিতের মতো শিক্ষক অচলায়তন ভাঙার কারিগর, আদর্শ গঠনের রূপকার! এই প্রশ্ন গুলো থেকেই যায়, শেষের পর্বে মূর্তি ভাঙার দৃশ্যও, সের্গেই আইজেনস্টাইনের “অক্টোবর” সাথেও হুবহু মিলে যায়।

এ যেন শিক্ষকের প্রতি তার ছাত্রের ট্রিবিউট। এ প্রশ্নের উত্তর তো আর আমাদের জানা হবে, খালি “ছুটবে আবার কল্পনা টা সত্যজিতের পথ ধরেই”।

শুভ জন্মদিন ‘মানিক’ বাবু…

__________________________

০২.০৫.২০২০

লেখা: রূপসা দাস