পাঠকের কলমে: আজকের গল্প ‘পদ্মদিঘীর পথে’, পর্ব: ১

।।১।।

চারদিকে বাতাসে একটা গুমোট ভাব।বঙ্গের ভাগ্যাকাশের মতোই।মনে হয় একটু ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে গেলে বাঁচা যেন।কিন্তু তা হওয়ার নয়।লাবণ্যবতীর আজ ঘুম ভাঙতে দেরী হয়ে গেল।এমনটাতো কখনও হয় না।দ্রুতপদে পা চালিয়ে সে নদীর ঘাটে যাচ্ছে।এই সকালেই তার যত কাজ।মন্দির ঘরে মাটি ল্যাপা,ফুল,বেলপাতা,দূর্বা, তুলশী পাতা,আম্রপল্লব তোলা।ঠাকুরের বাসন,ধূপ-দীপ দান পরিস্কার করা।গঙ্গাজলে ঘট সংস্কার করা,দুধ দোয়া,ঠাকুরের ভোগ তৈরী,বাড়ীর গাইবাছুর স্নানের পথে বাইরে বার করা,তার পর স্নান করে কূলদেবের নিত্যসেবা।স্নানের সময় লাবণ্য তার বালগোপাল কে সঙ্গে নিয়ে আসে নদীতে স্নান করাতে।তখনও বঙ্গে গোপাল পূজা সর্বজন বিদিত হয়নি।বাংলার ঘরে ঘরে,শহরে পল্লীতে হরগৌরী বা লক্ষীজনার্দনের যুগল আসন।কিন্তু লাবণ্য এই বালগোপাল কে ছাড়া একমুহূর্তও চলতে পারে না।এ কি তার শূন্যজীবনের অপূরণীয় আকাঙ্ক্ষা?না কি শিবাইগড়ের অছ্যুৎপল্লীর তার সেই নন্দধরের মুখচ্ছবি ওই মূর্তিতে খোঁজে? সে তার দাদা শিবনাথ কে বলে নবদ্বীপ থেকে এই গোপালকে আনিয়েছে।দাদা শিবনাথ নবদ্বীপে এক টোলের পন্ডিত।টুলোপন্ডিত দের এখন আর অত ভালো সময় নেই।তবুও মোটামুটি চলে যায়।

সকালের এই পর্ব মিটে গেলে সারাটাদিন লাবণ্যর আর কিছু করার থাকে না।আসলে তার বাবা হরিরাম চক্রবর্তী কন্যা কে ঘাটেরমড়া কুলীন পাত্রস্থ করে নিজের কূল রেখেছেন সত্যি কিন্তু তার কপাল যে এ জনমের মত পুড়লো তার খবর কে নেবে?অবশ্য সে সময় তার মতো কপালপোড়া এ পোড়াদেশে ঘরে ঘরে।

আজ যে তার দেরী হয়ে গেছে তা বাইরে প্রকাশ পেলেও মনে মনে তার কোন উদ্বেগ নেই।প্রতিদিন সময়ে উঠেও এই নিত্যকর্ম গুলি সে ধীরে ধীরেই করে।এগুলিই তার সময় কাটানোর একমাত্র অবলম্বন।মধ্যাহ্ন পেরিয়ে তার কাজ গুলি সম্পূর্ণ হলে সে দুটি খাবার মুখে দিয়ে একটু এদিন সেদিক এবাড়ী সেবাড়ী ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে একটু উত্তরের মাঠের দিকে উঁকিঝুঁকি মারে।মাঝে মাঝেই তার গরু খুটো ভেঙে যে উত্তরের মাঠে দৌড় দেয় তা কিন্তু সবসময় গায়ের জোরে নয়।মাঝেমধ্যেই খুটোটা কে যেন তুলে দিয়ে যায়।কে?শিবাইগড়ের জ্যান্তগোপাল নয় তো? যাইই হোক সেকথা সময়ে আমরা জানবো।

পোড়াজনার্দনপুর সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পল্লী। এ তল্লাটে লাবণ্যর রূপের কথা লোকের মুখে ফিরত।এখন বৈধব্য বেশে সে ছটায় ভাটা পড়লেও বঙ্গেশ্বরের অনেক বেগম তার রূপের কাছে ম্লান হয়ে যাবে।লাবণ্যর মা গত হয়েছেন বহুবছর।বাবা হরিরাম এখন খুব বেশী চলাফেরা করতে পারেন না।আর তার বউদিদি পার্বতীবালা শান্তশিষ্ঠ মিঠে মেয়েটি।এই তার পরিবার।শ্বশুরঘর কোথায় লাবণ্য তা জানে না।

তখনকার দিনে অনূঢ়া মেয়েদের যে বিধিনিষেধ ছিলো তা থেকে এইসব বাল্যবিধবারা অনেকটাই মুক্ত ছিলো।যে কোনো কারণেই হোক পাঠান বঙ্গেশ্বরের মুসলমান,বা হাবাসী বা অনেক জায়গায় নীম্নবর্ণের পতিত হিন্দুরাও ইসলাম নিয়ে প্রশাসকের তখতে বসে ব্রাহ্মণ মেয়েদের যে সর্বনাশ করতো তার মধ্যে অনূঢ়া কুমারীরাই তাদের লক্ষ্য ছিলো।মনেহয় কুলীন পাত্রের ঘরে কন্যা দেওয়ার যে স্বপ্ন বাংলাদেশের সব ব্রাহ্মণরা দিনরাত দেখতেন তাতে এই পন্থাই বোধহয় সর্বকঠিন কুঠারাঘাত।এতে এই অহংকারী কুলীন দের দর্পচূর্ণও হতো আর নিত্যনতূন ভোগও বেশ সহজলোভ্য হত।ময়মনসিংহের দেওয়ান, বঙ্গেশ্বর তেগান খাঁ এর সময় থেকেই সিন্ধুকী রেখে যেভাবে পল্লীতে পল্লীতে এই অবিবাহিত ব্রাহ্মণ কন্যাদের খোঁজ করে দিনেদুপুরে তুলে নিয়ে যেতেন তার চল এখন সারা বঙ্গে ছেঁয়ে গিয়েছে।কিন্তু বঙ্গের বিধবাগণ এবিষয়ে একটু সুরক্ষিত।যারা এমনিতেই আধমরা হয়ে আছে তাদের নিয়ে আর কিসের কূলচিন্তা!হায় বল্লাল তোমার কৃপায় সারা বাংলা এখনা বালবিধবাখানায় পরিণত হয়েছে আর তাদের দীর্ঘশ্বাসে বঙ্গদেশ আজ অভিশপ্ত।

নদীর ঘাটে গিয়ে সে যখন নামল তখন তো তার চক্ষু চড়কগাছ।একখানা নবাবী বজরা ঘাটের কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।তখনকার দিনে এ দৃশ্য খুব বিরল ছিলো না।নবাব,মন্ত্রী,দেওয়ান সবাই কমবেশী নদীপথে যাতায়াত করত।খাস পাঠানরা অতটা না করলেও এদেশী যবন রাজদরবারীরা নদীপথই বেশী পছন্দ করতেন। লাবণ্য দেখল মেয়েদের ঘাটে সবাই চান করছে বটে কিন্তু সবারই কেমন যেন তাড়াতাড়ি।যেন যত তাড়াতাড়ি পারে এস্থান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।

বিধবা হলেও একেবারে রাজারাজড়রার সামনে থেকে অযাচিত বিপদ ডেকে আনতে এই নীরিহ পল্লীতে কেই বা চাইবে?লাবণ্য তাড়াতাড়ি ঘাটে নেমে ডুব দিল।বজরাটা কাছে পৌছনোর আগেই চান সেরে চলে যেতে হবে।এমনিতেও বেলা আজ বেশী হয়ে গেছে।

___________________________________

লেখক: তন্ময় মণ্ডল