সরকার পড়ছে মধ্যপ্রদেশে, এর সঙ্গে প্রায় কোনও সম্পর্ক না থাকলেও, কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে, রাজস্থানের কংগ্রেস নেতাদের। ইতিমধ্যেই, ‘সিন্ধিয়া-কাণ্ডে’র মধ্যেই দিল্লিতে ডাক পড়েছে রাজস্থানের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলতের। দফায় দফায় বৈঠক করছেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতারাও। এদিকে তৎপরতা শুরু পদ্ম শিবিরেও। জ্যোতির পড়ে শচীন, টার্গেট এবার অন্যদিকে? আরেকটি সফল দাবা চালের পর, এমনই জল্পনা শুরু হয়েছে দেশজুড়ে।
এর কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ ‘খবরওয়ালা টিভি’কে জানাচ্ছেন, কয়েকটি কারণের কথা। সেগুলো আদতে কী?
আসলে, সিন্ধিয়া পরিবারের শুধু মাধবরাজ সিন্ধিয়ার কংগ্রেসসঙ্গ ছাড়া, বাকি প্রায় সকলেই বিজেপিতে। রাজমাতা বিজয়রাজ সিন্ধিয়া ছিলেন বিজেপির সঙ্গে। মধ্যপ্রদেশের বিখ্যাত এই পরিবারের দুই কন্যা তথা জ্যোতিরাদিত্যের পিতা, মাধব রাজের দুই বোন, যশোধরা সিন্ধিয়া, বিজেপিনেত্রী এবং মধ্যপ্রদেশ বিজেপির অন্যতম বিধায়ক। আরেকজন সিন্ধিয়া কন্যা, রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেত্রী বসুন্ধরা সিং রাজে। তাঁর পুত্র দুষ্যন্ত সিংও বিজেপিতেই। সুতরাং, সবেধন নীলমণি জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াই ছিলেন, কংগ্রেসের বর্তমান সিন্ধিয়া সম্পদ। রাহুল গান্ধীর অতি ঘনিষ্ঠ এই ‘বন্ধু’-নেতা, পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো, তাঁর পিসিদের মতো, ঠাকুমার পথে পা দিয়ে, বিজেপিতে প্রথম থেকেই নাম লেখাননি। বাবার পথ অনুসরণ করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, তাঁর এই দলত্যাগের ফলে, রাজস্থানের সিন্ধিয়া-রাজ বেশ শক্তিশালী হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই, বসুন্ধরার খানিকটা ‘ত্যাগে,’ শচীন পাইলটের মতো নেতাকে বিজেপি টানতে পারে দলে। শচীনকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের ‘টোপ’ দিয়ে, রাজস্থানেও সরকার ফেলে দিতে পারেন নরেন্দ্র মোদি -অমিত শাহ-বসুন্ধরা রাজে’রা।
এই সম্ভাবনা থেকেই চিন্তা শুরু হয়েছে কংগ্রেসের অন্দরে। খুব কঠিন লড়াই ও টানটান বিধায়ক সংখ্যা নিয়ে ওই রাজ্যে সরকার আর কতদিন হাতে থাকবে, তাই-ই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
এদিকে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিজেপিতে আনুষ্ঠানিক যোগ দিচ্ছেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে, কেন্দ্রের মন্ত্রী অথবা নিজের রাজ্যের নতুন উপ-মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন তিনি। কেন্দ্রে-রাজ্যে বিজেপিতে গিয়েও বিরাট প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা তাঁর।
এদিকে, একজন ব্যক্তির দল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গোটা রাজ্যের সরকার পড়ে যাওয়া, বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মত রাজনৈতিক ওই মহলের। তাঁদের দাবি, জ্যোতিরাদিত্য এঁর মতো কংগ্রেসের যুবমুখ সমগ্র রাজ্য দাপিয়ে, মানুষকে কংগ্রেসের গুরত্ব বোঝাতে সক্ষম হলেও, নির্বাচনে জেতার পর, সরকারের নাগাল দেওয়া হয়েছে প্রবীণদের হাতে। যা ভালোভাবে নিতে পারেননি এইসব যুবনেতারা। তারপর, বিশেষত, মধ্যপ্রদেশের মতো বড়োরাজ্যে বিপুল জনপ্রিয় এই নেতার দলত্যাগ, প্রভাব ফেলবে বড় অংশের জনতার মধ্যে। একধাক্কায় অনেকটা দুর্বল হতে পারে কংগ্রেস। রাজস্থানেও যদি সিন্ধিয়ার প্রভাব পড়তে শুরু করে, তাহলে আরও বিপাকে পড়তে পারে সোনিয়া গান্ধীর দল। পরোক্ষে হলেও, খানিকটা বোধহয় তা আঁচ করেছেন লোকসভার কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীও। তিনি এএনআইকে জানাচ্ছেন, ‘জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার দল ছাড়া যথেষ্ঠ প্রভাব ফেলবে। মধ্যপ্রদেশের সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমরা সরকার হারাতে পারি।’ এর পাশাপাশি তিনি, সিন্ধিয়ার কংগ্রেস ছাড়া নিয়ে তোপও দেগেছেন বিজেপিকে।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার সকালেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করেন জ্যোতিরাদিত্য। ২০ বিধায়কের বেঙ্গালুরুতে বেপাত্তার দাবির মধ্যেই সিন্ধিয়ার বিজেপি যোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। সোমবারও কংগ্রেসের তরফে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁর তরফে, ‘ফ্লু হয়েছে’ বলে এড়িয়ে যাওয়া হয় এই যোগাযোগ প্রক্রিয়া। এদিনই লিখে ফেলেন পদত্যাগপত্র। আজ মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ টুইটারে পোস্ট করা হয় সেই চিঠি। যেখানে, সোনিয়া গান্ধীকে উদ্দ্যেশ্য করে লেখা, ‘১৮ বছরের সম্পর্ক ত্যাগ করছি, এই দলে থেকে মানুষকে কথা দেওয়া কাজ করতে সক্ষম হচ্ছি না। আমার শুভাকাঙ্খী সমর্থকরা চান আমি নতুনভাবে শুরু করি।’
এই ট্যুইট এর পরই তোলপাড় শুরু হয় দেশীয় রাজনীতিতে। সিন্ধিয়ার মত কট্টর মোদি-বিরোধী নেতার কংগ্রেস-সঙ্গত্যাগে চক্ষু চড়কগাছে ওঠে একাংশের। জল্পনা-কল্পনা শুরু হয় বিজেপি-যোগের। কিন্তু সেই জল্পনা আর বেশিদূর এগোয়নি। বিজেপিতে যোগ দিয়ে, রাজ্য সভার সাংসদ তো হচ্ছেনই, উপরন্তু পেতে পারেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীত্ব। এমনকি তাঁর ঘনিষ্ঠ, একই সঙ্গে দল, বিধায়ক পদ ছাড়া তুলসী রামের মতো প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা হতে পারেন, ভাবি বিজেপি সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির গোষ্ঠী অসন্তোষকে প্রাধান্য দিয়েই, জ্যোতিরাদিত্য ঘনিষ্ঠ একাধিক বিধায়ক হতে পারেন নতুন মন্ত্রিসভার মন্ত্রী।
বিজেপিতে এই একটি ‘যোগ’ উলোট-পালোট করে দিয়েছে সব, শিবরাজ সিং চৌহানের এক বছরের বিরোধী জীবন বদলে যেতে চলেছে, বিজেপির রাজ্য জয়ের পালে দারুণ হওয়া লাগতে চলেছে। প্রায় নিশ্চিত এসব।
এর পাশাপাশি একপ্রকার নিশ্চিত, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বের পদ। মধ্যপ্রদেশ সরকারে তাঁর প্রভাব বজায় থাকাও প্রায় তৈরি। তাই, এতকিছু পাওয়ার সম্ভাবনা ত্যাগ করে, নিজের দুই পিসি আর পরিবারকে অখুশি করে, আর কংগ্রেসের হয়তো থাকতে চাননি তিনি। কমলনাথের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিবাদকে রাস্তায় নামিয়ে, বেশ বদলাও নিয়ে ফেললেন, এক রাজ্যের সরকার তো বটেই, পরোক্ষে জল্পনা তুলে দিলেন, আরেক রাজ্যের সরকার হারানোরও। এক ঢিলে মেরে দিলেন একাধিক পাখি, এমনই মত রাজনীতির কারবারিদের একাংশের।
১০.০৩.২০২০