‘পদ্মদিঘীর পথে’ দ্বিতীয় পর্ব : তন্ময় মণ্ডল

।।২।।

মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গিয়েছে।দিনোমনি মধ্যগগন থেকে পশ্চিমে ঝুঁকে পড়েছে। শিবাইপুর ভদ্রস্থ ব্রাহ্মণদের কাছে অচ্ছ্যুৎ নেড়া পাড়া। এ পল্লীতে সবাই মোটামুটি চাষবাসে অভ্যস্ত। নন্দধরের বাবা জটাধর মূর্তি তৈরি করতো। তার তৈরি পাথরের মূর্তির এ অঞ্চলে খ্যাতি ছিল।দেশ-দেশান্তরে তার মূর্তি গড়ার ডাক পড়তো। কিন্তু এদেশে বক্তিয়ার এর শাসন চালু হওয়ার পর সেই সুদিন আর নেই। কত মূর্তি,মন্দির পাঠান সেনারা ভেঙে শ্মশান করে দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই।এখনতো পল্লীতে পল্লীতে সিন্ধুকীরা কুমারী ব্রাহ্মণ মেয়ে আর মূর্তি তৈরির খোঁজ পেলে যবন সেনাদের খবর দেয় আর মুহূর্তের মধ্যেই মেয়ের জাত কূল মান যায় আর মূর্তি ভেঙে গুঁড়ো হয়ে পড়ে থাকে যবন সেনার পায়ের নিচে। নন্দধর দের তো বহুকাল থেকেই খারাপ অবস্থা। ছোটবেলায় নন্দ ধর বাবার কাছে শুনেছে আগে তার পূর্বপুরুষরা সদ্ধর্মে দীক্ষিত ছিল। তখন এদেশে বৌদ্ধ বিহার গুলির বেশ রমরমা ছিল। এখনো তাদের ঘরে বুদ্ধের ভাঙা মূর্তি আছে। আর সেকালে ব্রাহ্মণদের ও এত বাড়াবাড়ি ছিল না।আদিশূর দক্ষিণ থেকে আসার পর যে কনোজিয়া ব্রাহ্মণদের আনলেন তাদের অত্যাচারে সারাবাংলা আজ বিপন্ন।আর একথাও সত্যি শেষকালে বৌদ্ধবিহার গুলি ব্যভিচারের আখড়ায় আর তন্ত্রসাধনার পীঠস্থানে পরিণত হয়ে উঠলে বৌদ্ধরা সমাজে পতিত হয়ে পড়ে।

নন্দন নিজেও তা ভালোভাবে বোঝে। অত্যাচারের ভয়ে এদেশে পাথর আর কাঠের মূর্তি তৈরি বন্ধ হয়ে গেল।সিন্দুকীদের চোখ এড়িয়ে তাড়াতাড়ি পূজো সারবে বলে বলে মাটির মূর্তির পূজা প্রচলন হতে শুরু করল। ব্রাহ্মণ সমাজ নন্দধরদের না ছুঁলেও তাদের তৈরি মূর্তিতেই পুজো করত। উচ্চ ব্রাহ্মণ সমাজে তখন কুমোর কামার ছুতোর এসব বৃত্তির প্রচলন ছিল না। একবার তার বাবা হরপার্বতীর যুগল মূর্তি তৈরি করে তার হাতে দিয়েছিলেন পোড়াজনার্দনপুরে পৌঁছে দিতে। সেখানে সে হাঁটতে হাঁটতে মনের ভুলে পল্লীর ভেতরে ঢুকে পড়েছিল।তাকে দেখে উপস্থিত ব্রাহ্মণদের মাথায় যেন বাজ পড়েছিল।ত্রাহি ত্রাহি রবে যে যেখানে পারছিল তার থেকে দূরে পালানোর চেষ্টা করছিল।সঙ্গে গালাগাল অভিশাপ তো দিচ্ছিলোই, কয়েকজন বুড়ো আবার পথে নুড়ি পাথর তার দিকে ছুঁড়তে শুরু করে। কোনোক্রমে সেদিন সে মূর্তি খানা রেখে পালিয়ে বেঁচেছিল।একটি ব্যাপার শুধু তার চোখে এখনো ভাসে একটি এগার বারো বছরের মেয়ে অদ্ভূতভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। বহুদিন পর্যন্ত তার সেই মুখ আর চাহনিখানা মনে ছিল। আগেতো এই পল্লীতে কবিরাজ বদ্যিও আসতো না। এখন অনেকে যবণ ধর্ম গ্রহণ করার পর একটু শান্তিতে আছে তারা।না হলে আগে ব্রাহ্মণরাই রাতের আধারে ঘরে আগুন দিয়েছে গরু-বাছুর কেড়ে নিয়ে গেছে।

নন্দধরের বয়স এখন প্রায় তিরিশের কাছাকাছি। সে তার বাবার সাথে মূলত চাষের কাজই করে,তাদের দুটি গাঈয়ের দেখাশোনা তারই হাতে। আর অবসর সময় মাঝে মাঝে একটু ছেনি বাটালি নিয়ে কাঠের উপর ফুল ফোটায়, পাথর কেটে মূর্তি গড়ে। বাবার মতো সে মাটির বিগ্রহে আগ্রহ পায় না। মাঝে মাঝে গাঈ চরাতে তাকে আশেপাশের মাঠে ঘুরতে হয়।তেমনি প্রায় বছর তিনেক আগে তার একখানা গাঈ দড়ি ছিঁড়ে পোড়াজনার্দনপুর এর দিকে ছোটে। তার খোঁজে নন্দধর সেখানে গেলে হঠাৎ দেখে একটি বিধবা মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তারই গরু নিয়ে তার দিকে ছুটে আসছে।হঠাৎ নিজের গরু দেখে নন্দধরও মেয়েটির দিকে ছুটে যায়।নন্দধর কাছাকাছি পৌঁছলে মেয়েটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাড়িয়ে যায়।গরু যে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির বুঝতে পেরে দড়ি ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়ায়।মেয়েটির পরনে সাদা কাপড়, চুল ছোট করে কাটা, বয়স ষোলোর কোঠায় হবে। গাঈয়ের দড়ি ধরে মেয়েটিকে হাতজোড় করে প্রণাম করে সরে আসে নন্দধর। বয়সে ছোট হলেও ব্রাহ্মণ তো ! সেদিন যখন সে ফিরে আসছিল একবার পিছন ফিরে দেখল মেয়েটি তার দিকে তখনও তাকিয়ে আছে। মাঠে লাঙ্গল টানা,বাড়িতে ছেনি বাটালি চালানো নন্দ ধরে চেহারা বেশ পেশীবহুল। তার উপর শ্যামলা বর্ণ আর লম্বা গঠন। তার চোখের লজ্জা বুঝতে পেরে মেয়েটিও পিছন ফিরে দৌড় লাগিয়েছিল।কিন্তু চাহনীটা যেন বড্ড চেনা।তাহলে কি এ সেই মেয়ে।

আজ প্রায় বছর তিনেক হতে চললো লাবণ্য আর ছুটে পালায় না। মাঝে মাঝে গরু ছোটার আছিলায়, কখনো বা সাঁক তোলার বাহানায় বা আরো হাজারো অজুহাতে তারা প্রাইই কাছাকাছি আসে। লাবণ্য কোনদিনও স্বামীসোহাগ পাইনি।সংসার, শ্বশুরবাড়ি কি এসব সে জানে না। তার উপর তার এই ভরভরন্ত বয়স।সবমিলিয়ে পতঙ্গ যেমন বিপদ জেনেও আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে,তারও সেই অবস্থা।আর নন্দধর সবকিছু জেনেও লাবণ্যকে উপেক্ষা করতে পারে না।তার ব্যকুলতা,চোখের জলের সাথে এক হয়ে যায় তারই বানানো মূর্তির মতো লাবণ্যর শরীর।নন্দধর ছাড়া কেউ কখনও লাবণ্য কে কাঁদতে দেখেনি। লাবণ্যর চোখের জলে অনেকবার ভিজেছে নন্দধরের কোল,কাঁধ।আর শুধু জলই দেয়নি লাবণ্য আদরে সোহাগে সেও ভরিয়ে দিয়েছে নন্দধরকে। ব্রাহ্মণ পল্লীর পশ্চিম দিকে একটি পরিত্যক্ত ভুতুড়ে জঙ্গল মতো আছে।সেখানে কতদিন নন্দর কাধে মাথা রেখে লাবণ্য বা লাবণ্যর কোলে মাথা রেখে নন্দ বিকেলের লাল সূর্য দেখেছে।তপ্ত দুপুরে সেই জঙ্গলের ছায়ায় লাবণ্য নন্দকে দিয়েছে কর্পূর আর মিছরীর মঠ মেশানো ঠাণ্ডা জল আর কোমল আঁচল পেতে দিয়েছে স্নেহের পরশ দিয়ে।এজীবনে নন্দ আর বালগোপালই তার আপন আর কেউ নয়।আসলে দুজনেই এক লাবণ্যর কাছে। না, ভূতের ভয় তাদের নেই।এ পোড়া দেশে ব্রাহ্মণ,জাত আর কূলক্ষয়ের চাইতে বড় ভূত আর কিছু নেই।

__________________

এই গল্পের প্রথম পর্বের লিঙ্ক:

https://www.khoborwalatv.com/post/writer-s-column-story-segment-s-1st-episode-of-padmadighir-pathe-by-tanmoy-mandal-offbeat _______________________

লেখক: তন্ময় মন্ডল