নিভে গিয়েও জ্বলে রইল ‘সাঁঝবাতি’, ‘লিলি’র প্রভাবে আবিষ্কৃত এক অন্য দেব‌ও। ্কলমে জয়সূর্য ঘোষ

নিভে গিয়েও জ্বলে রইল ‘সাঁঝবাতি’, ‘লিলি’র প্রভাবে আবিষ্কৃত এক অন্য দেব‌ও। ্কলমে জয়সূর্য ঘোষ

Updated: Apr 13

জয়সূর্য ঘোষ

‘মাটি’র পর ফের বড়দিনে, বড়পর্দায় ফিরলেন পরিচালক শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাংলা ধারাবাহিকের পরিচিত মুখ, লীনা গঙ্গোপাধ্যায় জুটি। শিবপ্রসাদ-নন্দিতার পর, ‘সাঁঝবাতি’র মতো অন্য ঘরানার ছবি নিয়ে আগমন তাঁদের। বন্দ্যোপাধ্যায় জুটির সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবিতে বঙ্গজীবনের, বিশেষ করে, শহর কলকাতার কর্মব্যস্ত জীবনের খুব চেনা একটি ছবি ফুটে উঠেছে।

আসলে, কাজের প্রয়োজনে আজকাল হামেশাই শোনা যাচ্ছে মা-বাবাকে ছেড়ে ছেলে মেয়েরা উচ্চ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে, বিদেশে চলে যাচ্ছে। আর এদিকে বৃদ্ধ মা-বাবা পরিচারকের তত্ত্বাবধানে দিন কাটাচ্ছেন। কখনও আবার তাঁদের ঠাঁই হচ্ছে কোনও বৃদ্ধাশ্রমে। ক্রমে সেই পরিচারকরাই হয়ে উঠছে তাদের সন্তান, তাঁদের ভালো থাকার রসদ। আবার কখনো ভালোমানুষির আড়ালে এরাই হয়ে উঠছেন আতংকের। এই সমসাময়িক পরিস্থিতিকেই সুন্দর করে বুনেছেন পরিচালকদ্বয়। ছবির নাম রেখেছেন ‘সাঁঝবাতি’। অর্থাৎ জীবনের সায়াহ্নে এসে যারা একটু আলোর সন্ধান দেয়, তারাই তো সাঁঝবাতি জ্বালাতে পারে। এই ছবিতে বৃদ্ধা মা সুলেখা দেবী (লিলি চক্রবর্তী) অনবদ্য। সুলেখা, কাজের মেয়ে ফুলি (পাওলি দাম)-কে নিয়ে থাকেন সল্টলেকের মতো একটি ফাঁকা জায়গার দোতলা বাড়িতে। বিলেত ফেরত ডাক্তার ছেলে (সুদীপ চক্রবর্তী) প্রায় রোজই ভিডিও কলে বিদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু মা সুলেখা দেবী তাঁর যৌবনকালের ভরা সংসারের বাড়ি ছেড়ে ছেলের কাছে যেতে নারাজ। ছোট ছেলে ট্রেকিং করতে যাওয়া আকস্মিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, তাঁর পুরনো স্মৃতি, সেই ভরা সংসারের গন্ধ মিশে থাকা বাড়িটা ছেড়ে তিনি কী করতে বিদেশে যাবেন? ফুলি ছাড়াও সুলেখা দেবীর কাছের মানুষ বলতে ‘ছানা দাদু’ যে চরিত্রে রয়েছেন প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর ছোট ছেলের হবু বউ রূপকথা বা মুন্নীর চরিত্রে সোহিনী সেনগুপ্ত। সল্টলেকের মতো জায়গায় দোতলা বাড়ির এমন বিধবা মালকিন হলে স্বাভাবিকভাবে যে কেউই পাড়ার প্রমোটারদের চক্ষুশূল হবেন। ফলস্বরূপ তাঁরাই গুণ্ডা লাগিয়ে সারাদিন উত্যক্ত করতে থাকে বছর পচাত্তরের সুলেখা দেবীকে। এমন অবস্থায় সেখানে সুলেখা দেবীর ‘কেয়ার-টেকার’ হিসেবে আবির্ভাব হয় বকুলতলা গ্রাম থেকে রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টারের (সন্তু মুখোপাধ্যায়) ছেলে চন্দন চট্টোপাধ্যায় ওরফে চাঁদু (দেব)। প্রথম দিনেই দিদার বাড়িতে এসে মিষ্টি কথায় নাতি হয়ে মন জয় করে নেয় চন্দন বা চাঁদু। বাজার করা, বিদ্যুতের বিল জমা করে আসা, প্রায় সবকিছুই করে চাঁদু। এমনকি তার মিষ্টি ব্যবহার ও কথার জাদুতে বুড়ো হাড়ে প্রাণ ফিরে পান ছানা দাদুও। প্রথমে ঠোকাঠুকি লাগলেও পরে ভালোবেসেও ফেলে কাজের মেয়ে ফুলি। তবে এখানে ফুলির অতীত জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট কোনকিছু বলা হয়নি। তাঁর চরিত্রের মধ্যে জায়গা বিশেষে কিরকম একটা অবাঙালি ছোয়া দেখা যায়, কথার মধ্যেও খানিক ‘স’ এর দোষ কানে লাগে। অর্থাৎ সে কোথা থেকে এসেছে, তাঁর বাড়ির পরিবেশ পুরোটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে। সিনেমার শুরুতেও একটা খটকা থেকে যায়। আবার উদ্দম নাচ-গানের মাধ্যমে সিনেমার শুরু প্রয়োজন ছিল কিনা? প্রশ্ন ওঠে তা নিয়েও। যদিও এরকমভাবে চলতে চলতেই পরিচালক গল্পে মোড় ঘুরিয়ে দিলেন, চাঁদুর বাবার শরীর খারাপ ঘটিয়ে। সে হন্তদন্ত হয়ে তাঁর মিষ্টি দিদা-দাদুকে ছেড়ে বকুলতলা ফিরে যায়। ওদিকে প্রোমোটারের চাপে দিদার জীবন যখন অতিষ্ট, তখন তদানীন্তন অ্যাকশন ফিল্মের মারকাটারি চ্যালেঞ্জরুপী দেবকে পাওয়া গেল না। কারণ পরিচালকের নির্দেশে সে এখানে দায়িত্ববান, কর্তব্যপরায়ণ একজন ছেলে। এখানে একটি ব্যাপার নজরে এল যে পরিচালক যখন শ্যুটিং স্পট হিসেবে সল্টলেকের মতো একটি ওয়েল এস্টাবলিস্ট জায়গাকে বেছে নিয়েছেন তখন দিদা গুণ্ডাদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে একবারও পুলিশের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবেননি কেন? পুলিশকে এতো নিষ্ক্রিয় রাখার কারণটাও পরিষ্কার হল না। যদিও সিনেমাতে সবই হয়। কল্পনা আর বাস্তব এখানেও যেন মিলেমিশে একাকার। তবে চিত্রগ্রাহক শীর্ষ রায় সল্টলেকের নির্জন রাস্তার সঙ্গে বকুলতলা গ্রামের পুকুর, মাঠঘাট, চাঁদুর বাড়ির গ্রাম্য পরিবেশের খুব সুন্দর মিশ্রণ করেছেন। ক্যামেরার কাজ এক কথায় অসাধারণ। ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপশি তাল মিলিয়ে অনুপম রায়ের ‘ক্ষমা করো আমি ভালো নেই’ গানটি খাপ খেয়ে গেছে। তবে দর্শকের মনে সেভাবে দাগ কাটেনি। ছবিতে আরও দুটো গান শোনা যায় একটি শানের ও আরেকটি অন্বেষার গলায় তবে এই গান দুটিও দর্শকের মনে সেরকম প্রভাব ফেলেনি। গল্পের অন্তিম পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে দেব অর্থাৎ চাঁদু বাবার শরীর ভালো হয়ে যাওয়াতে গ্রাম থেকে ফিরে আসে। কিন্তু সেই গুন্ডাদের অত্যাচারের হাত থেকে দিদাকে বাঁচাতে পারলো না সে, অন্যায়ের কাছে হেরে গিয়ে দিদা পরলোকে চলে গেলেন। কালীপুজোর রাতে মাত্রাতিরিক্ত বাজি ফাটানোর জন্য দিদার হার্ট এ্যাটাক করে। শূন্য হয়ে গেল ‘সাঁঝবাতি’। একটি সাধারণ ছেলে হওয়াতে তাঁর মিষ্টি দিদার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে না পেরে ফুলিকে গুন্ডাদের লালসার শিকার থেকে বাঁচাতে চাঁদু ফুলিকে নিয়ে বকুলতলা ফিরে যায়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দিদার হঠাৎ চলে যাওয়ার ধাক্কাটা সব চেয়ে বেশি লাগল ছানাদাদুর। তিনিও অন্যায়ের কাছে হার মেনে তাঁর ছেলেমেয়ের কথা মতো কোন এক বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও হবু ছোট বউমা রূপকথার তৎপরতায় গল্পের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দর্শককে আসনে বসিয়ে রেখে, আবেগ ঘন মুহূর্ততে টান টান উত্তেজনায়, একরকম প্রায় তাল মেলানোর জন্য দিদার মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিতে পারলেও, চাঁদু আর ফুলি আবার গ্রাম থেকে ফিরে এসে তাদের দাদুকে যেতে না দিয়ে, বরং দাদুর সাথে থেকে গিয়ে একটি নতুন জীবন শুরু করে। যেখানে পরিচালক জুটি নিঃসন্দেহে যে কোন আবেগঘন বাঙালীর হৃদয় ছুঁয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন একশো শতাংশ।

url; leena-and-shaibal-banerjee-s-new-bengali-film-sanjhbati-s-review-by-khoborwala-tv

Edited by Ramen Das