নতুন বছরেও আজ ‘গাঢ় অন্ধকার’! মেলা-উ‌ৎসবের শূন্যতার মাঝেই বাঙালির ঘরে ঘরে শুভ নববর্ষ!

‘রাত্রি পোহাইল… কাননে কুসুমকলি’, প্রতিদিনের মতো শোভা বাড়ালেও, এবারের নববর্ষের শুরুটা অন্যদিনের থেকে অনেক আলাদা! সমস্ত আলোর মাঝেও, নতুন দিনটিও করোনা-রূপী সন্ত্রাসের কালো নিকষ অন্ধকারে বন্দি। তবুও তো চলতে হয়, তবুও এগোতেই হয় প্রতিমুহূর্তে! এই পয়লা বৈশাখ, একটা নতুন দিনের শুরু হলেও, তার আগেরদিন অর্থাৎ গতকালের দিনটিকে ঘিরে রয়েছে অনেক কথকতা। রয়েছে একাধিক জীবন-জীবিকা, বাঁচার অবলম্বন। এই উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় ভিড়, গাজন, মেলা- যা ভাত জোগাত একাধিক পেটে, আজ সেখানেও শূন্যতা!

প্রসঙ্গত, চৈত্রসংক্রান্তি একসময় গ্রামীণ জনপদের প্রধান উৎসব হলেও কালের প্রবাহে নাগরিক জীবনেও তা স্থান করে নেয়। এ উপলক্ষে দেশজুড়ে চলে নানান ধরনের উৎসব, মেলা, এদিনেই হয় চড়কপূজা যা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মালম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসবও বটে। চৈত্রের শেষ দিনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিনদিনব্যাপী চড়ক পুজোর উৎসব চলে বহু জায়গায়। দূর থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন। সবটা আজ বন্ধ।

আসলে, এটি চৈত্রমাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন, উৎসবের একটি অঙ্গ, এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে, যা চড়কসংক্রান্তি মেলা নামে খ্যাত। যেমন মালদহে গাজনের নাম গম্ভীরা, জলপাইগুড়িতে গমীরা। বাংলা পঞ্জিকার চৈত্রমাসের শেষসপ্তাহ জুড়ে দেশের সব প্রান্ত থেকে আগত সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার অন্যতম উৎসব এই গাজন মেলা ও চরক পূজা। কিন্তু এইবছর চিত্র অন্য হাওয়ায়, স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন ছোট কুটির শিল্পের ব্যবসায়ীরা সহ বহু খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের এই মেলা, উৎসবের মাধ্যমে চলে জীবিকানির্বাহ। ভাতের অভাব পূরণ হয় বহু মানুষের।

গোটা দেশজুড়ে এখন লকডাউন, তাই সবচেয়ে বিপাকে গ্রামের বাসিন্দারা। এই উৎসবের ফলে বহু মানুষের আগমন ঘটে প্রতিবছর, যা এই বছর পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন! ফলে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত, কারণ, লোক না আসলে, কিনবে কে? তাই, বেচাকেনা প্রায় বন্ধ।

প্রসঙ্গত, আজ বাংলার ঐতিহ্যময় উৎসব, বাঙালির পয়লা বৈশাখ তথা বৈশাখ মাসের শুরু। পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস, বৈশাখের ১ তারিখ ) বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। দিনটি পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয়, ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সেই হিসেবে দেখতে গেলে এটি বাঙালিদের একটি সার্বজনীন লোকোৎসব হিসেবে বিবেচিত।

এই উৎসব শোভাযাত্রা, নাচ-গান, মেলা, মিষ্টিমুখ, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হলো ‘শুভ নববর্ষ’।

এ দিন প্রত্যেক বাঙালিদের বাড়িতে চলে মিষ্টি মুখ, বড়োদের প্রণাম, আছে নতুন জামা দেওয়ার রীতি| প্রত্যেক স্বর্ণকার ব্যবসায়ীদের দোকানে চলে নতুন হালখাতা, মিষ্টির প্যাকেট ও নতুন বছরের ক্যালেন্ডার বিতরণ সকল গ্রাহকদের। লক্ষ্মী-গণেশের পুজো করে শুরু হয় নতুন বছর। তবে এ বছর চিত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা। লকডাউনের জেরে ঝাঁপ বন্ধ সমস্ত স্বর্ণকার ব্যবসায়ী সহ ব্যাবসায়ীদের দোকানের।

বছরের শেষ দিন চৈত্রসেলের জেরে লোকের ভিড়ে ঠাসা থাকে জামা কাপড়ের দোকান। এবছর ছোট-বড়ো কাপড় ব্যবসায়দের শিরেসংক্রান্তির দশা! চারিদিকে ধুধু করছে, বন্ধ সব দোকানের ঝাঁপ। ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে, ফুটে বসা কাপড় ব্যবসায়ী সহ বহু ব্যাবসায়ী। বাঙালির প্রাণের মিষ্টির দোকান আপাতত খুললেও মানুষ হাতে গোনা। পয়লা বৈশাখের আগে বিক্রি নেই লক্ষী- গনেশের, মাথায় হাত সব মৃৎশিল্পীদের‌ও। গুটিকতক মৃৎশিল্পী মূর্তি নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে শহরের আনাচে-কানাচে বসলেও বিক্রি নেই, তাই তাঁরা পড়েছেন ভয়ানক আর্থিক সংকটে। রাত পোহালেই নববর্ষ, ছোট-বড়ো বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সহ দোকানে দোকানেও এদিন লক্ষ্মী-গণেশের পুজো হয় তবে এবছর দেশজোড়া চলছে লকডাউন তাই এই রীতি এবারের জন্য আপাতত বন্ধ।

উল্লেখ্য, এই অবস্থায় মাথায় হাত পড়েছে মৃৎশিল্পী সহ রাজ্যের সব জীবিকার ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের| তাই কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দোকান ছাড়া বন্ধ বাকি সব দোকান। ফলত, সমস্ত বিকিকিনি একেবারে বন্ধ বললেই চলে। গোটা দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে সকলের ঘরে বসেই কাটল, নতুন বছরের প্রথমদিন! তাই যেন বিষাদগ্রস্ততায় গোটা বাঙালি জাতি। একরাশ শূন্যতা নিয়েই বলে উঠছেন, শুভ নববর্ষ!

লেখা: রুমকি সরকার

কলকাতা

১ লা বৈশাখ, ১৪২৭

(১৪.০৩.২০২০)

edited