দূরত্বেও ‘আতঙ্কহীন’ জনতা! কেউ ভরছেন রাজপথ! কেউ আছেন বাজারেই! —#PostEditorial

রাস্তায় বেরিয়ে ‘গুলতানি’ কী এখনও মারবেন! কেউ কেউ বলছেন একথা! কেন বলবেন না? আসলে, ২১ মার্চ ছিল ২৮৩! ২৯ মার্চ দুপুরেই হল কমপক্ষে ১০৫০ এর আশেপাশে! অনেকেই বলছেন, আমেরিকার মতো পরীক্ষা হলে, এই সংখ্যায় হতে পারত কয়েকহাজার।

কিন্তু, গুজবে জনতাকে কান দিতে বারণ করা হলেও, মাটি বলছে কিন্তু অন্যকথা! সতর্ক তো বটেই, একটু আতঙ্কিতও হচ্ছেন কেউ কেউ। আর হবেনইবা কেন!

চিন, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, আমেরিকার মৃত্যু মিছিল ছাড়িয়ে, ভারত হবে না তো নতুন এপিসেন্টার? ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে না তো এদেশে? নাকি সত্যিই এইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে? যা প্রকাশ্যে আসছে না?— একাধিক প্রশ্ন উঠছে!—- ‘করোনা’ মোকাবিলায়, আর্থিক প্যাকেজ, পরিকল্পনা, রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রতিশ্রুতির পরেও প্রশ্ন উঠছে। আর তা উঠছে কিছু কারণে!

আসলে, বরাবরই বলা হয়, সব পরিসেবা নাকি ধনীদের জন্যই! এই প্রবাদবাক্য দিকে দিকে এখনও প্রচলিত। করোনার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল কি? অনেকেই বলছেন, বিদেশ থেকে বিশেষ বিমানে অনেককেই ফিরিয়ে আনা হলেও, আগে থেকেই দিল্লির পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়নি কেন? আর সেটা না করাতেই অসহায়তা প্রকট হচ্ছে। তার দরুণ, স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়েছে আতঙ্ক।

খেতে পাব তো? বাড়ি ফিরতে পারব তো? সত্যিই বাঁচব তো? এই ভাবনাতেই দিকে দিকে, ফাঁকা জাতীয় সড়কে ভিড় জমেছে। গরম পিচের রাস্তায় পা পুড়েছে! আবার কেউ ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন! আবার রাস্তাতেই কারওর সাহায্যে পেটে ভাত জুটেছে ওদের। তবুও ওরা ফিরতেই চেয়েছে। ভিনরাজ্য থেকে বাড়িতে। নিজের ঘরে ফিরতে চেয়েছে প্রতিনিয়ত। আর এই ফেরার তাগিদেই দিল্লির আনন্দবিহার বাসস্ট্যান্ডে মারাত্মক ভিড় তৈরি হয়েছে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে সকলেই, একসঙ্গে ফিরতে চেয়েছ। যা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে পুলিশকে!

কিন্তু সামাজিক দূরত্ব? যে দূরত্বটুকু বজায় রাখার জন্যই এই ‘লক ডাউন’। যা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের সক্রিয়তা। ব্যাংকে টাকা। ফ্রীতে রেশন। জরুরি পরিষেবা বাদ দিয়ে, বাকিটা বন্ধ রাখা। এই ভাইরাসের ছড়িয়ে যাওয়া ঠেকানোর জন্য অনেককিছু করা। যা নিয়ে চিন্তিত গোটা বিশ্ব। কিন্তু যে কারণে এই পদক্ষেপ, তার একটুও আনন্দবিহারের ওই ছবি দেখে মনে হচ্ছে? নাহ!

যে ভিড় দেখেছে দুনিয়া। তাতে শঙ্কা, ভারতের আক্রান্ত সংখ্যা একলাফে বাড়বে না তো কয়েকহাজার! আর তারা যে গ্রামে ফিরবে, সেখানেও কোনও ভাবে সংক্রমণ ছড়াবে না তো? এই প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলেছে চিকিৎসকদের। একাংশ বলছেন, এই ছবি দেখে শিউরে উঠছি, কী করছিল প্রশাসন?— অবাক হচ্ছেন তাঁরাও। কারণ, সবচেয়ে চিন্তা তাঁদেরই। লড়াইটা সামনে থেকে লড়ছেন চিকিৎসকরাই।

নেই! তাদের জন্য, অর্থাৎ অসহায় মানুষের জন্য ঠিকঠাক ব্যবস্থা সত্যিই নেই, অথবা ছিল না। থাকলে এই ভিড়, এই অনিয়ম দেখতাম আমরা? তাদের মুখে হাসি দেখতাম, ওই বিমানযাত্রীদের মতো। কিন্তু আরেকটি চিত্রও ভাবাচ্ছে আমাদের! কী?

যে ভিড় আপনি দেখছেন! এর পাশাপাশি আপনার, আমার বাড়ির পাশের বাজারের ভিড়ের মিল পাচ্ছেন? হ্যাঁ! পাচ্ছেন। মাছ, মাংস, সবজি কিনতে, উৎসব পালনের খাদ্য জোগাড় করতে হামলে পড়ছেন কেউ কেউ! এদের শুধুই চিন্তা, রুই কালিয়া আর চিংড়িভাপা খাওয়ার! নিজের ভালো থাকার। তাই বাজারে গিয়ে যত্রতত্র, কে আগে নেবেন, সেই চিন্তামগ্ন থাকাটাও চলছে জোরকদমে। ঠিক, করছেনও তাই! বাজারে ভিড় করছেন। চায়ের দোকানের অর্ধেক খোলা ঝাপের ফাঁকা থেকেই, দিব্যি আড্ডাতে মশগুল হচ্ছেন। ধুস! করোনা আবার কে? ওর কোনও ক্ষমতা আছে নাকি? তাঁদের গায়ে স্পর্শ করতে। সবাই মরে গেলেও তাঁরা বাঁচবেনই! ‘সুপার হিউম্যান’ এঁরা, না মানেন পুলিশ। না মানেন প্রশাসন। না রোগের ভয়। কিন্তু কারওর জ্বর হলেই, তাঁকে বয়কট! লড়াকু চিকিৎসক, নার্সদের বাড়ি ভাড়াতে রাখলে, ঘর ছাড়ার কথা বলা, সবটাই এই সমস্ত ‘সুপার ম্যানে’দের দ্বারা সম্ভব!

কেমন? ধরা যাক, ওই বাড়িতে জ্বর হয়েছে, এই বাড়িতে কাশি। আবার তাঁর বাড়িতে হাঁচি হয়েছে। এই খোঁজ নিতে সিদ্ধহস্ত এই সুপারম্যানদের কৃতিত্বে বাড়ি ছাড়া হচ্ছেন কেউ কেউ! কিন্তু এরা ক্রিকেট খেলতে, তাস খেলতে, অথবা একটু চা খেয়েই চলে যাব বলতে দারুণ আগ্রহী। ধুস, আমার তো কিছু হবেনা বলে, ভারতকে ইতালির দিকে ঠেলে দিয়ে, আবার দিল্লির ওই লোকগুলো কী বাজে! এটা বলতেও দারুণ সক্রিয়।

এদেশে ‘হিপোক্রিট’, অথবা ‘কাঠি’ প্রদানকারীর সংখ্যা অনেক। একজন কাঠি প্রদানকারী পিতার, কাঠি প্রদানকারী সন্তান, সেই পরম্পরা বজায় রাখতেই দারুণ তৎপর। তাই, বছরের পর বছর ধরে এরাই দেশের সব খারাপকে তীব্র সমালোচনা অথবা মিনমিনে বেড়ালের মতো বসে থাকতে পছন্দ করলেও, আদতে কীভাবে দেশের এই অবস্থা সৃষ্টি করা যায় তা করতেও দারুণ আগ্রহী।

কিন্তু সব কী এই ‘অযথা ভিড়’ করা জনতার দোষ? রাষ্ট্রের কোনও দোষ নেই? আছে! রাষ্ট্রের দোষ আছেই। বহুদিন আগে থেকেই, বিদেশে এই ভাইরাসের প্রকোপ বাড়া শুরু হতেই, আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা বন্ধ করা যেত। অথবা নিয়ন্ত্রণ। বাধ্যতামূলক আইন।—-কোয়ারেন্টাইনে যেতেই হবে। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন আছে, তাহলে বিদেশে অবস্থানরত দেশের ছাত্র, প্রবাসীরা কীভাবে ফিরতেন? তবুও দোষ কিন্তু রাষ্ট্রের। নিয়ন্ত্রণ জরুরি ছিল। যতই, ‘ইস্যু’ চাপার অভিযোগ আসুক না কেন! দেশের স্বার্থে কড়া নির্দেশ জরুরি ছিল প্রথমেই। যদিও, অর্থনীতি নিয়ে আর প্রশ্ন নেই, ব্যাংকের হাল নিয়ে দুঃখ নেই! নীরব মোদি নিয়ে বিতর্ক নেই! নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়েও আর বিক্ষোভ নেই! কোনও হিন্দু-মুসলমানও নেই! সবাই এক, সরকারের সব ‘দোষ’ঢেকে গিয়েছে। একটা ভাইরাস মিলিয়েছে যেমন সব, বিপরীতভাবে অনেক সঠিক প্রশ্ন ওঠাকেও আটকে দিয়েছে আজ। কেউ বলছেন না চাকরি নেই কেন? এখন ৫ মিলিয়নের চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকলেও, তাঁরাও চুপ!

কারণ, সবার আগে বেঁচে থাকা! এটাতে ভর করেই নুন-ভাতেই পেট চালাচ্ছেন বহু মানুষ। কোটি কোটি ঘরে দুপুরের পর রাতে আদেও খেতে পারবে কিনা, জিজ্ঞাসা থাকলেও, তারাও চুপ! শুধু বেঁচে থাকার আকাঙ্খায়!

তবুও কেজরিওয়ালের মতো শাসকের হঠাৎ মনে হল বাস দিই! ব্যাস, একপ্রকার ইচ্ছা করেই বিপদের মুখোমুখি হয়ে গেল হাজার হাজার মানুষ! এদের থেকে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে দায় নেবেন কে?

৭০ শতাংশের বেশি মানুষ যে দেশে গরিব। দিন আনা দিন খায়। যাদের ইচ্ছা থাকলেও অনেক অনেক সামগ্রী কিনে রাখার উপায় নেই। তাঁরাও আজ প্রতিমুহূর্তে নিরুপায় হয়েই জীবন কাটাচ্ছেন। আর তাঁদের সেই অসহায়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছি আমরা।

আমরায়! যাঁর যত বেশি টাকা, তাঁর তত বেশি জিনিস কিনে ঘরে রাখার প্রকোপ বৃদ্ধি করে, যার ইচ্ছা থাকলেও টাকা নেই, তাকেই যা অচিরেই ঠেলে দিচ্ছে অতল গহ্বরে।—ভেবে দেখুন। আপনি অনেক টাকা নিয়ে মুদির দোকানে গেলেন। কায়েককেজি মুড়ি কিনলেন। কিন্তু যে মানুষটা রোজ ২ টাকার মুড়ি কিনে সকালের ক্ষুদা নিবারণ করেন? তিনি খিদে থাকলেও, আর পেলেন না সেই মুড়ি! এভাবেই ইচ্ছাকৃত সংকট তৈরি হয়েছে। আর তারপরেও, সব বোঝার পরেও, তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দেখা যাচ্ছে বাজারে! দূরত্ব বজায় না রেখে, গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে বাজার করতে। অনেকেই মাস্ক তো দূর! যেন কিছুই হয়নি বলে এগোচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বেঁচে না থাকলে খাব কীভাবে! এই প্রশ্নের থেকে, তাঁদের মধ্যে কাজ করছে, সবার আগে আমি খাব, সবার আগে আমি নেব। সব সবজি আমার। সব বাজার আমার। হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, এই লক ডাউনের পর, তাঁর বাড়ির ছেলেটি বা মেয়েটিই বেকার হতে পারেন। আজীবন করতে হতে পারে, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’।

‘অবনী’ সারাজীবন থাকতে পারেন বাড়িতেই! তবুও এঁরা অবিচল। তবুও চায়ের দোকান, সেলুন, তাস খেলা, ক্রিকেট, ফুটবলে এরা পরিপাটি। এরাই সর্বেসর্বা। তাই বারবার দেশকে আরও, আরও ‘লক ডাউনে’র দিকে ঠেলে দেওয়ার পরেও এরা অবিচল! প্রতিনিয়ত, দিনমজুর মানুষটার চোখের জল দেখার পরেও, এরাই সমালোচনায় মশগুল। রাষ্ট্রকে ‘ইস্যু’ সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার পরেও এরা বাজারে। তবুও এরা রাস্তায়।

তবুও কোনও জরুরি প্রয়োজন ছাড়াই এরা রাস্তার ভিড় দেখতে বেরিয়ে পড়েন।

তাই, মনে হয়, সাম্প্রতিককালে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে এক আদিবাসী বৃদ্ধ, ঢোল পিটিয়ে সচেতনতা প্রচার করছেন। অনুধাবিত হচ্ছে, এই তথাকথিত সুশীল সমাজের মধ্যে না থেকে যদি ওই বৃদ্ধের মতো হতে পারতাম, তাহলে, ‘করোনা’ হয়েও মৃত্যু হলে শান্তিই পেতাম!