রাত্রি পোহাইল! অদ্য ঠকানোর দিন আসিল! থুড়ি, ঠকবার দিন আসিয়া পড়িল! কেন? আসলে, দিনের পর দিন। সূর্যের পর সূর্য পূবআকাশে উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও, আপনি ক্লান্ত হলেন না। এখনও জমিয়ে আড্ডা, কিম্বা একটু জমাটি খুনসুটি! কী নেই আপনার জীবনে। শুধু আছে, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা সবকিছু সংকুচিত অথবা প্রসারিত করে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে, একটি এবং অদ্বিতীয় প্রশ্ন,
‘আমরা খাব কী?’ কিন্তু একজন সত্যিকারের না খেতে পাওয়া মানুষের তুলনায়, আপনি আদেও না খেয়ে আছেন কিনা? তা নিয়ে শতাধিক প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও, এই প্রশ্নেই ভিড় জমিয়ে দারুণ চিন্তিত আপনারা! আপনাদেরই বলছি, কারণ, আমি বা আমার মতো ভারতের আসল দেশপ্রেমী মানুষেরা এটা করছেন না!
আচ্ছা, ধরা যাক, আপনি মুসলিম ? রোজার সময়? অনেক অনেক খেতে থাকেন? আর হিন্দু ধর্মের দাদারা? পরিবারের কেউ মারা গেলে কী খেয়ে থাকেন? কালীপুজোর উপোসের দিন কী খান? খ্রিস্টানরা ‘ক্রিসমাস-নাইটে’র মতো উদযাপনে,কী কী খাবেন, আদেও মনে থাকে?—– যদিও, আমরা অধিকাংশই, প্রতিদিন একবারও খোঁজ নিই না!পথেঘাটে থাকা মানুষগুলো কতদিন খালি পেটে থাকেন! একবারও ধর্মীয় উদযাপনে ভাবি না, কী খাব, কী খাব না! মত্ত থাকি মচ্ছবে। কিন্তু এখন? নিজের ভালো থাকার মূলমন্ত্র কী, তা জেনেও, বিপরীত আচরণে মত্ত হচ্ছি বিরাট অংশ! তাঁরা, দিব্যি খোশমেজাজে মোচ্ছবে মেতে উঠছেন এখনও। দেশকে ঠেলে দিচ্ছেন আরেকটা ‘ইতালি’র দিকে।
হাবড়ার তরুণী বাড়িতে। তিনি সুস্থ। সচেতন নাগরিকের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ভালো আছেন। কিন্তু আমরা? ‘আমার হবে না’ অথবা আমরা এইমুহুর্তে ‘সুপারম্যান’ বা ‘শক্তিমান’ ভেবে এখনও নিশ্চিন্তে থাকছি! কয়েকহাজার আক্রান্তের পরেও, বেলঘরিয়া, তেহট্ট… নয়াবাদ…দমদম… শিলিগুড়ি… একের পর এক জায়গার নাম সামনে আসার পরেও, দিল্লির এক ধর্মীয় সভার পরিস্থিতি, একাধিক মৃত্যুর খবরের পরেও, থালা বাজিয়ে রাস্তায় নামার পরেও, আমরা এখনও সত্যিই শোধরায়নি। প্রতিমুহূর্তে, সমানে বলে চলেছি, ‘আমাদের কিছু হবে না’! থুড়ি, আমাদের কিছু হতেই পারে না! যদি হত, তাহলে কেন রোজ, বিরিয়ানি নিতে ছুটছি! দৌঁড়চ্ছি কিছু বিনামূল্যে পাওয়ার আশায়। যাঁর টাকা আছে, তিনিও যাচ্ছেন বাজারের ব্যাগ ভরতে!
কিন্তু জানেন, আপনারাও হতে পারে! আপনি দিনমজুর হলেও হতে পারে, আপনি বড় আমলা
হলেও হতে পারে। কারণ, আপনার সংস্পর্শে ওই ‘নির্বুদ্ধি’ আমলার ছেলের মতো কেউ আসতেই পারে! রোগ যখন আসে, কে-কী, কার স্ট্যান্ডার্ড কত উপরে, সেটা বোধহয় বিচার করে আসে না। এতদিনে নিশ্চিতভাবে জানি আমরা, করোনা ছড়িয়ে যায়
দ্রুত। কিন্তু আশার কথা, এই রোগ তুলনায় লোক ‘মারে’ কম।
তবে ভারতের মতো দেশে, যেখানে এখনও হামলে পড়তে দেখতে হয় বাজারে। যেখানে সামাজিক দূরত্বের কথা ফুৎকারে উড়িয়ে, ভিড় জমে মিষ্টির দোকানে। যেখানে, খাসির মাংসের দোকানেও আড্ডা জমে অচিরেই। সেখানে ‘করোনা’র সঙ্গে যুদ্ধে জিততে, ‘লক্ ডাউনে’র কোনও প্রয়োজন এখনও আছে কি? নিশ্চিত নেই! যে উদ্দেশ্যে দেশের এই পরিস্থিতি
নামিয়ে আনা হয়েছিল। শাহিনবাগ, অর্থনীতি, দাঙ্গা, বেকারত্বের সমস্ত ইস্যু সরিয়ে, শুধুমাত্র করোনার মোকাবিলার কথা বলা হচ্ছিল! সরেজমিনে খোঁজ নিন। উদ্দ্যেশ্য আপনার জন্য অনেকটা ব্যর্থ! যেটুকু সফল সবটাই একটা অংশের সচেতন মানুষের জন্য। কিন্তু, আমাদের ভালোর জন্য যে উদ্যোগ, সবটাই মাঠে ফেলে পিষে দিচ্ছি আমরাই। বাড়িতে ড্রাম-ড্রাম চাল থাকা সত্ত্বেও, আমরাই ভিড় করছি রেশন দোকানে। আমরাই বাজারে যাচ্ছি। পুলিশ পেটালে বদনাম করছি। আবার আমরা বলছি দেশটা শেষ হল!
আবার, একপ্রকার অপ্রয়োজনীয় আশঙ্কা নিয়ে, দিন আনা দিন খাওয়াদের অসুবিধায় ফেলে, নিজেদের ‘স্টক’ বাড়াচ্ছি। রীতিমত, কে কত বেশি কিনে ঘরে রাখতে পারি, তার চিন্তায় মত্ত থাকছি। আর অজান্তে না, একপ্রকার জেনেই দেশকে ঠেলে দিচ্ছি আরেকটা শুধু নয়, একাধিক ‘লক্ ডাউনে’র দিকে। অর্থনীতির অবনমনের দিকে। মিলিয়ন মিলিয়ন আরও বেকারত্বের দিকে। বোয়াল মাছের পেটে আরও খাদ্য ভরার দিকে।
‘তহবিল’, যা আমার-আপনার টাকার, সেটা থেকে দান করে, জনপ্রতিনিধিদের আত্মপ্রচার করার দিকে। ভেবে দেখুন, আপনি যদি সতর্ক হন, আপনি যদি ক’দিন একটু ঘরে থাকেন, আপনি যদি এইকদিন একটু কম খেতে পেয়ে থাকেন। যদি পাশের বাড়ির, সত্যি অভুক্তকে একটু সাহায্য করেন। তাহলে? আজীবনকালের জন্য ভালো থাকবেন আপনিই। জনপ্রতিনিধিদের সুযোগই হবে না, মানুষের টাকার তহবিল থেকে দান করে ফলাও আত্মপ্রচার করার! বরঞ্চ বেশি করে সামনে আসবে, খেটে রোজগার করা তারকাদের নাম। সাধারণ মানুষের নাম, যাদের তিল তিল করে কষ্টের টাকা আসছে তথাকথিত ত্রাণ তহবিলে।
তবুও আপনি চা খাচ্ছেন! তবুও আপনিই, ফ্রিতে রেশন নিতে সবার আগে যাচ্ছেন। বাড়ির কাজ বন্ধ করা পরিচারিকার মাইনে দিতে দেরি করছেন। আপনিই
এসব করছেন। কারণ, আপনার তো কিছুই হবে না! আপনি তো ‘ঈশ্বর’ বা ‘আল্লাহ’র দূত। তাই
আপনার শরীরে ‘করোনা’ আসার কোনও সম্ভাবনায়
নেই। বেলঘরিয়ার দোকানদার, বড় বাজারের ব্যবসায়ী ভদ্রলোকও কি এটাই ভেবেছিলেন?
আপনি ভাবছেন না? যদি নাইই হয়, তাহলে এখনও গলাবাজি করে গুলতানি মারছেন কেন! আপনার অনেক প্রতিরোধ ক্ষমতা, ড্রেনের জল থেকে বল তুলেছেন। মাঠে কাজ করেছেন। অনেক খেটে খান। তাই আপনার তো কিছুই হবে না!
যদি হয়? তখন? হাসপাতালে বেড, যাওয়ার অ্যাম্বুল্যান্স! ওষুধ? চিকিৎসক পাবেন তো? গুজবে কান দেবেন না ঠিকই! কিন্তু নিজের ভালোর জন্য, সকলের ভালোর জন্য, একটু ভয় পেতে পেতেই ভেবে দেখবেন কি? তাই, এইরকম করতে করতে, তারস্বরে নিজেদের নিজেই বলে উঠুন, ‘এপ্রিল ফুল’!!!
©️রমেন দাস
P.C: Tweeter, Writer
১ এপ্রিল, ২০২০