সালটা ১৯১৯। অপ্রতিরোধ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মনে তখন ভয়, হাড় কাঁপানো ভয়। উপমহাদেশের সমবেত জনতা পাছে তাঁদের গদিছাড়া করে সেই ভয়। মরিয়া হয়ে উঠল ইংরেজ সরকার। ভাবল ‘কালাআদমি অসভ্য’ ভারতীয়দের উপর অত্যাচার বাড়িয়ে দিয়ে যদি তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ভুলিয়ে দেয়া যায়। তৈরি হল কুখ্যাত রাউলাট আইন। ভারতীয়দের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করার এই দমনমূলক আইন বলবৎ করা হল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ।
এই আইনের প্রতিবাদে এবং ইংরেজ সরকারের দমনমূলক আচরণে পাঞ্জাবের অমৃত্সর শহরে ১৩ এপ্রিল, ডাকা হল এক প্রতিবাদসভা। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে। দিনটা ছিল পাঞ্জাবের অন্যতম উৎসব বৈশাখীর দিন। সকাল থেকে ধীরেধীরে ভরে উঠল উদ্যানপ্রাঙ্গন। শিশু, নারী,বৃদ্ধ,বৃদ্ধা সহ নিরস্ত্র ১৫-২০ হাজার ভারতীয়। তারা তখনও জানেনা কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্যে!
শহীদ বিপ্লবী উধম সিং
হঠাৎ করেই বাগানে ঢুকে পড়ল ৫০ জন সশস্ত্র ব্রিটিশ সেনা। ঘিরে ফেলল উদ্যান চত্ত্বর। জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে শুরু হল গুলিবর্ষণ। কি হচ্ছে তা বুঝে ওঠার আগেই ৫০টি রাইফেল থেকে ১০মি ধরে চলল গুলিবর্ষণ। মোট ১৬০০ রাউন্ড। প্রাণ
হারালো শতাধিক মানুষ। পালানোর পথ না পেয়ে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে অন্যদিকে যাওয়ার চেষ্টা করলো অনেকে। কেউ কেউ ঝাঁপ দিলো কুয়োয়। মারা গেলেন প্রায় ৪০০জন। আহত ১২০০। সেটা অবশ্য ব্রিটিশ সরকারের হিসাব। প্রতিষ্যদর্শীদের মতে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১০০০ জনের বেশি। মুহূর্তের মধ্যে রক্ত, ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ ভরে গেল উদ্যান চত্বর। চারিদিকে আহতদের বীভৎস চিৎকার, বাঁচতে চাওয়ার আকুতি। না, ব্রিটিশ সরকারের নৃশংসতার গল্পটা এখানেই শেষ নয়। সান্ধ্য-আইন জারি করে আহতদের শুশ্রূষা করাতো দূরে থাক, মৃত্যুগামী মানুষগুলোর মুখে জল ও দেওয়া হলনা।
নৃশংস জেনারেল ডায়ার
ওই ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের নৃশংসতার ছবি স্পষ্ট করে দেয়। প্রতিবাদ, ধিক্কারে মুখর হন বহু বিশিষ্টজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্যাগ করলেন নাইটহুড উপাধি। তৈরি হল জেনারেল হান্টারের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি। যদিও সেটা প্রহসনের নামান্তর ছিল।
এই ঘটনার প্রতিবাদ বা প্রতিশোধের কথা যদি বলতে হয়, চোখ রাখতে হবে ১৯৪০ সালের, ১৩ মার্চ। স্থান লন্ডনের কাক্সটন হলের গন্যমান্য সমাবেশ। বক্তব্য রাখবেন মাইকেল ও ডায়ার। হ্যাঁ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সেই কুখ্যাত খলনায়ক। সাহেবী কেতাদুরস্ত সাজে ঢুকলেন উধম সিং। সভা শেষ হতেই পকেট থেকে বের করলেন পিস্তল। নিশানা তাক করে গুলি চালালেন। দুটি বুলেটে লুটিয়ে পড়লেন মাইকেল ও ডায়ার। বোধহয় মৃতদের আত্মা এতদিনে সঠিক বিচার পেল। আর কি আশ্চর্য সমাপতন। তারিখটা ছিল ১৩ !
সেই রক্তাক্ত ১৩এপ্রিলের পর কেটে গিয়েছে আরও ১০০ বছর। ২০২০ সালে দাঁড়িয়েও আজ পর্যন্ত কোনো ক্ষমা চায়নি ব্রিটিশ সরকার। কেন? এটা কি বিশ্বশাসন করা একদা শ্রেষ্ঠ জাতির লজ্জা, কুণ্ঠা নাকি অহংবোধ ?? ভাববেন আপনারাই।
লেখায় ও ছবি: স্বাতী সেনাপতি
১৩.০৪.২০২০