চোখের জল আর কষ্টের হোলিকাকে সঙ্গী করেই, সাদাশাড়ীতে আজও রঙ লাগে শ্রীমত্যাদের।

‘দোল পূর্ণিমার নিশি পালন আকাশ, ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস, লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ন, নানা সুখে, নানা কথা করি আলাপন।’ ব্রতকথার, লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে দোলের আবহে নারায়ণের সুখকথা হলেও, বাস্তবের ‘নারায়ণহীন’ লক্ষ্মীদের জীবনে সুখ আছে কি? না নেই। আসলে, এটাই হলো তাঁদের জীবন, তাঁদের জীবন উপজীব্য!

বৃন্দাবনের বিধবারা!

যাঁদের জীবনের ‘নারায়ণ’ হারিয়ে যাওয়ার পর ঠাঁই হয়েছে বৃন্দাবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। যাঁদের, একদিনের সাদাশাড়ী পরিহিত জীবনে রোজই রঙ লাগে দুঃখের। তবুও তাঁরা ভালো থাকেন। বাঁকে বিহারীর সাধনা করে ভালো থাকার চেষ্টা করেন বারবার।

অবজ্ঞা, যন্ত্রণাকে একপ্রকার অবহেলা করেই, জীবনের দুঃখের ‘হোলিকা’দের বারবার যেন পুড়িয়ে ফেলতে চান। ভুলে যেতে চান এক কাপড়ে, হাওড়া থেকে মথুরা যাওয়ার কথা, ঘর ছেড়ে বিনা টিকিটে পৌঁছে যাওয়ার কথা। না খেয়ে দিনের পর দিন থাকার কথা!

তবুও, মানু ঘোষ-সাধনা- লক্ষ্মীদের অনেক চেষ্টার পরেও, তাঁদের জীবনে হাজির হন না ‘প্রহ্লাদে’র মতো কেউ। কষ্টের আগুন থেকে বাঁচাতে আসেন না ‘বিষ্ণু’ও। কিন্তু সব অন্ধকারের মধ্যেও ফাল্গুনী পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভরসা করে, কৃষ্ণ নামে হোলি খেলেন তাঁরাও। উৎসবের রঙে রাঙিয়ে নেন ধবধবে সাদাশাড়ী। বাঁকে বিহারীর বাঁকে রাঙিয়ে নেন নিজেদের। বহুবছর আগের মতো, সিঁথি ভরে ওঠে লাল অথবা নীল কিম্বা হলুদ ফাগে।

আজ তাই, দোল উৎসব পালন করছেন তাঁরাও। মায়াপুরের বিদেশি আতিশয্য ছেড়ে, দেশজুড়ে বিশেষত, বঙ্গের দোল বা বসন্ত উৎসবের জমজমাট আসর ছেড়ে, তাঁরা আজ বিবাগী। তাঁরা আজ ঘর ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে, জন্মভূমি ছেড়ে, সারাদিন হরিনাম আর ভিক্ষার থলি ছেড়ে, খেলছেন হোলি। চোখ মুছে যেন বলে উঠছেন, ‘হোলি হ্যায়…!’

বৃন্দাবনের বিধবা-কাহিনী বহুকাল ধরেই আলোচিত। মূলত, ২০১২ র পর থেকে এর প্রভাব বাড়তে থাকে। বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশের পর জানা যায়, মূলত, বাংলা, তারপর আসাম, ওড়িশা থেকেই উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবন অঞ্চলে হাজির হন বৃদ্ধ মহিলারা। অনেক কম অংশে হলেও তাঁদের মধ্যে দেখা যায়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো অন্য রাজ্যের অনেককেই। হাওড়া স্টেশন অথবা তাঁদের রাজ্যের কোনও স্টেশন থেকে বিনা টিকিটে বৃন্দাবন পৌঁছে, অত্যন্ত কষ্টের দিনযাপন করেন তাঁরা। খুঁজে নেন কোনও মন্দির। যেখানের চাতালে কীর্তন গান, ভিক্ষা করে, ক্রমে ক্রমে থাকার জায়গা জোগাড় করেন ওই বৃদ্ধারা। যাঁদের মধ্যে বিবাহিত মহিলার সংখ্যা থাকে খুব কম। সর্বভারতীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তথ্যচিত্র জানাচ্ছে, প্রতিবছর প্রায় ১ হাজারের বেশি বিধবা মহিলারা, নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে হাজির হন, বৃন্দাবনের মন্দির অঞ্চলে। মূলত, ভিক্ষাবৃত্তি করেই যাঁদের দিন চলে। প্রশাসনের তরফে এঁদের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ সম্প্রতি নেওয়া হলেও, হাজির সকলকেই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে সরিয়ে নিয়ে, অন্য জীবিকা দেওয়া এখনও সম্ভব হয়নি, বলেই মত সংশ্লিষ্টদের।

জানা যায়, সন্তানহীন অথবা সন্তান থাকতেও তাঁদের অবহেলা অত্যাচারই ঘর ছাড়তে বাধ্য করে এঁদের। মানু ঘোষ, সাধনার মতো বৃন্দাবনের ‘শ্রীমত্যা’রা বলে ওঠেন তাঁদের সেই করুন কাহিনী।

মানু’রা বলেন, ‘আমাদের স্বামী নেই, তবে একটা সংসার ছিল, কিন্তু এখন তাও নেই। সন্তান আমার নেই, কিন্তু আমার পাশে থাকা প্রায় সবার আছে, তবুও তারা দেখে না, দোষ কার বলো? ‘ভিক্ষা করে, রাধাকৃষ্ণের গান করে, হাঁটু ব্যথা নিয়েও সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় একটু খাব বলে, ভাত জোটে না রোজ, এখন একটু ভালো আছি, তবুও…’ চোখ মুছতে মুছতে বললেন আরেক বৃদ্ধা। হোলি খেলেন না?- ‘হ্যাঁ। এখন খেলি, অনেকে এসে নিয়ে যান খেলার জন্য, ছবি তোলেন, অনুষ্ঠানে ডাকেন,’- উত্তর দিলেন আরেকজন।

এই বিধবারা যেন এযুগের সীতার মতো, অপরাধ না থাকলেও সমানে দিয়ে চলেছেন অগ্নিপরীক্ষা, সেটা রামে’র মতো রাজার প্রজাদের সামনে না, নিজেদের দুঃখ নামক বন্ধুর কাছে। কষ্ট নামের চোখের জলের কাছে। তবুও তাঁরা ভালো আছেন। তবুও তাঁরা রঙে আছেন। রাঙিয়ে আছেন নিজেদের মতো করেই।

দোলের দিন সকালে, আবিরে রাঙানো রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁরাও মেতে উঠছেন রঙের উৎসবে। একবিংশ শতাব্দীর বিশশতকের আধুনিক সময়ে তাঁরাও ছড়িয়ে যাচ্ছেন দিকে দিকে। সাদাশাড়ী, সাদামাটা মনের গল্পকারদের জীবনে, খুব ধীরে হলেও হাজির হচ্ছে, একটু রঙের কাহিনী। তাই, এই বছরের হোলিও যেন না চাইতেই তাঁদের কাছে হয়ে উঠছে ভালোথাকার রসদ।

প্রসঙ্গত, বহুকাল ধরে অপেক্ষার পর, রঙের মতো করে তাঁদের জীবনেও একদিন আসে ভালো খবর। এক আশার আলো। ২০১২ সালের ৩ আগস্ট একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষ আদালত জানতে চায়, রাষ্ট্রীয় ন্যায় প্রদানকারী সংস্থা, এই, অসহায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ এর বেশি বিধবার জন্য কী করতে পারে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন, ভগবানের দূতের মতো এগিয়ে আসেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সুলাভে’র কর্ণধার ড. বিন্দেশ্বর পাঠক। মূলত তাঁর উদ্যোগেই থাকার জায়গা থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা, ক্রমে ক্রমে প্রায় ৯৫০ জন বিধবা বৃদ্ধাকে মাসিক ২ হাজার ভাতা দেওয়া, স্বনির্ভর করে তোলার প্রচেষ্টা করার মতো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিজেদের তৈরি রাখি পরান বৃন্দাবনের ওই বৃদ্ধারা। ক্রমেই বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে ওঁদের চোখের জলের কাহিনী। প্রকাশিত হতে থাকে করুণ দিনযাপনের ইতিহাস।

এই ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেই সাদাশাড়ীতে লাগে একটু ভালো থাকার রঙ। তাই যেন, বিধবারাও সব ট্যাবু ছাড়িয়ে, বাঁকে বিহারীর মন্দিরের বাঁকে আজও রাঙিয়ে যান। যার দরুন, একটু ভালো দিন কাটে তাঁদের। সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে, বৃন্দাবনের বিধবাদের জীবনের রঙ সম্পূর্ণ ফ্যাকাশে থেকে হয়ে উঠেছে খানিকটা রঙিন। বেরঙিন তকমা থেকে, কষ্টের দিনেও আগমন ঘটছে একটু সুখের ‘গুলাল’।

লেখা: রমেন দাস

ছবি সৌজন্যে: রয়টার্স, টুইটার।

(Pictures Courtesy: Reuters)

#অন্য_হোলি

০৯.০৩.২০২০