কেমন আছে একাকী তিলোত্তমা ? কী অবস্থা কলকাতার প্রকৃতির ?- বিশ্লেষণ করলেন পরিবেশবিদ ড. মোহিত রায়।

‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ’- জীবনানন্দ দাশের এই উক্তির সার্থকতায় বলাই যায় লকডাউনের পৃথিবীতে সত্যি এক অন্য পৃথিবীর আস্বাদ রয়েছে। গোটা বিশ্ব যখন একটা ‘লকডাউন’-র ঘেরাটোপে বন্দি, তখনই প্রাণ মেলে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিরা, বন্যপ্রাণ মেতেছে যেন উচ্ছ্বাসে, কোথাও নেই কোনো দূষণ, প্রকৃতির কোলে যেন মাথা রেখেছে জগত।

প্রসঙ্গত, করোনার জেরে কার্যত স্তব্ধ বিশ্ব। লকডাউনে ধুঁকছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এরই মাঝে পরিবেশের সামনে খুলে গেছে এক মুক্ত দ্বার। ওড়িশার উপকূলে ফিরে আসছে কচ্ছপ, মুম্বইয়ের রাজপথে নাচছে ময়ূর, কেরলের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ, এইসব দেখা সম্ভব হয়েছে লকডাউনের সৌজন্যেই। এবার প্রায় তিন দশক

পর কলকাতার বিভিন্ন ঘাটে দেখতে পাওয়া গেল বিলুপ্তপ্রায় সাউথ এশিয়ান রিভার ডলফিন, যার আরেক নাম গঙ্গা শুশুক| এর পাশাপাশি বাংলা যেন ফিরে পেয়েছে তার আদি রূপ। এই পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের সঙ্গে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে কলকাতার বাতাসও।

কলকাতার প্রকৃতির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খবরওয়ালাটিভি.কমে’র সঙ্গে কথা বললেন পরিবেশবিদ ডক্টর মোহিত রায়।

?সেই কথোপোকথন তুলে ধরা হল পাঠকদের উদ্দেশে –

খবরওয়ালাটিভি : দীর্ঘ একমাস লকডাউন এর ফলে জনবহুল কলকাতা শহরের ওপর পরিবেশগত কি কি প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বা আগামী দিনে এই প্রভাব কতটা সুফলের হবে বলে আপনার মনে হয়? মোহিত রায়: পরিবেশগত প্রভাব আপাতত যা হচ্ছে সেটা খুব ভালো, যেমন কলকাতার বায়ুদূষণ এত কমে গেছে যা সাধারণ মানুষ তাদের জীবনে রোজগারের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছেন, শব্দ দূষণ নেই যার ফলে কলকাতায় আমরা চারপাশে বহু পাখি দেখতে পাচ্ছি, সবমিলিয়ে প্রাকৃতিক অবস্থা ভালোই হয়েছে কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে লকডাউন পরিবেশ ভালো করার কোন প্রতিকার নয়। লকডাউন একটি বিশেষ অবস্থান, মানুষ অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে আছেন, তার মধ্যে এই পাওনাটা ভালো কিছু পাওনা। কিন্তু এটা নিয়ে খুব বেশি ভাবার কিছু নেই কারণ পরিবেশ ভালো করতে গেলে অন্যান্য উপায়ে ভাবতে হবে লকডাউন করে নয়।

খবরওয়ালাটিভি: আপনি একজন পরিবেশবিদ হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন কলকাতার আদি গঙ্গা রক্ষার্থে বহু লড়াই, বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, লকডাউনের জেরে কি একই গঙ্গায় দূষণের মাত্রা কমতে শুরু করেছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন গঙ্গার জল পানের উপযোগী হয়ে উঠেছে এর সত্যতা নিয়ে কি বক্তব্য আপনার?

মোহিত রায়: আমার মনে হয় এই যে রিপোর্টগুলো হচ্ছে গঙ্গাকে নিয়ে তা সম্পূর্ণ সত্য নয়, হরিদ্বারে গঙ্গার জল অনেক ভালো হয়েছে কারণ এটি একটি ধর্মীয় জায়গা, এখানে বহু মানুষ স্নান করেন, দ্বিতীয়ত এই ধরনের শহরগুলিতে প্রচুর মানুষ, পুণ্যার্থী থাকেন তার ফলে হোটেল-রেস্টুরন্ট, এসমস্ত জায়গার যে বর্জ্য জল সমস্তই নদীতে এসে পড়ে ফলে এসব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু জায়গায় গঙ্গার জল খুবই ভালো হয়ে উঠেছে, কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যদি আপনি সার্বিকভাবে গঙ্গা দেখেন, এই গঙ্গা দূষণের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে মানুষের ব্যবহারের জল থেকে, যেরকম আমাদের শহরের মিউনিসিপালিটির জল ঠিকমতন ট্রিটমেন্ট না হয়ে এসে পড়ে এবং সেখানে নদীর জল দূষিত হয়, কলকারখানা বন্ধ হওয়ায় কিছু কিছু শহর যেমন কানপুর ও পাটনাতে কলকারখানা এখন বন্ধ থাকায় সেখানকার গঙ্গার জল ভালো হয়েছে। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পানের উপযোগী গঙ্গার জল কখনোই হতে পারেনা, তার কারণ মানুষের ব্যবহৃত জল এসে পড়ছে গঙ্গায়, খাবারের জলে আমরা যেটাকে বলি কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া সেটা শূন্য থাকা উচিত, যেটা কখনোই গঙ্গার জলে শূণ্য থাকা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই আগের চেয়ে গঙ্গার জল ভালো হয়েছে কিন্তু এরকম ভাবার অবকাশ নেই যে তা পানের উপযুক্ত হয়েছে।

খবরওয়ালাটিভি : আমাদের রাজ্যের ফুসফুস সুন্দরবন, বহুদিন ধরে গাছ কেটে ফেলার কারণে সুন্দরবনের বাস্তু তন্ত্র হারিয়ে যাচ্ছে একপ্রকার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এই লকডাউনের কারনে কি সুন্দরবন তার রূপ বা গুণ কিছুটা হলেও ফিরে পাবে?

মোহিত রায়: ‘আমার মতে সুন্দরবন ও তার আশপাশ গ্রামীণ পরিবেশ হওয়ায় দূষণ সংক্রান্ত প্রভাব এখানে ততটা নয় তবে সুন্দরবনের প্রচুর নৌকা মাছ ধরতে যায়, আর এই সমস্ত নৌকাগুলি চলে ডিজেলের থেকে ফলে জল দূষণ বলুন বা শব্দদূষণ বলুন আছেই, তাছাড়া বহু মানুষ এখানে যায় তাদের তৈরিও দূষণ আছে। সুন্দরবনের দূষণ এই মুহূর্তে অনেকটাই কমেছে’ যার একটা সুন্দর প্রভাব থাকবেই তবে শহরাঞ্চলে যেমন গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ আছে ততটা নিশ্চিত প্রভাব না হলেও, সুন্দরবনের নদীতে প্রচুর মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের জন্য যাতায়াত করেন, সেই দিক থেকে এখন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক অবস্থা অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে।

খবরওয়ালাটিভি: জল দূষণের সাথে সাথে শব্দদূষণ কমে যাওয়ায় ফিরে আসছে বিলুপ্তপ্রায় শুশুক, ডলফিন। লকডাউন -এর পরবর্তী সময়ে কি দূষণের মাত্রা বেড়ে গেলে আবার এরা কি ফিরে যাবে?

মোহিত রায়: আমার তো মনে হয় আবার ফিরে যাবে এখন যেহেতু দূষণ কম, গঙ্গায় যত স্টিমার চলতো, জাহাজ চলতো এগুলো নেই আমাদের এদিককার কল-কারখানার জল নেই এবং সামগ্রিকভাবে নদীর ওপর যে কাজকর্ম বন্ধ আছে বলে শুশুকরা আবার দেখা দিয়েছে কিন্তু বাস্তবটা হচ্ছে যে আবার কাজকর্ম শুরু হয়ে গেলে তারা আবার তাদের জায়গায় ফিরে যাবে। খবরওয়ালাটিভি : পরিবেশ রক্ষার্থে লকডাউন কি উপযোগী? মোহিত রায়: না, লকডাউন-এর কারণ তো কখনোই পরিবেশ উন্নয়নের জন্য ছিল না, এটা

অন্যকারণে করা হয়েছে সুতরাং লকডাউন করে পরিবেশ-উন্নয়ন করলে সেটা মানুষের পক্ষে ভালো নয়, সব কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে নিশ্চয়ই পরিবেশ ভালো হয়ে যাবে কিন্তু তা দিয়ে তো মানুষের জীবন চলবে না বরং আমাদের এটা পজিটিভলি ভাবতে হবে যে সত্যি এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কিরকম হয় যা আমাদের ভাবার কোনো সুযোগ ছিল না। সুতরাং এখন আমরা যেটা বলতে পারি আমাদের একটা ভাল শিক্ষা নেওয়ার যে যদি আমরা দূষণ কমাতে পারি তাহলে শহরে এত ধরনের পাখি দেখা যাবে আবার, আমরা কি রকম কলকাতাকে দেখতে পারি শুধু কলকাতা না আগে আমরা যা কল্পনায় ভাবতাম এখন এই এক মাসে আমাদের তা চোখের সামনে এসেছে ফলে আমাদের সামনে চমৎকার একটা লক্ষ্য রয়েছে, আমরা আবার চেষ্টা করব গঙ্গায় যাতে শুশুক ফিরে আসে তার জন্য, আমরা হয়তো ভাবতাম শুশুকরা হয়তো ফিরে আসবে না কিন্তু আসে, সেটা পজিটিভ ব্যাপার। এই লকডাউন আমাদের সামনে পরিবেশ উন্নয়নের জন্য একটা লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে।

খবরওয়ালাটিভি : লকডাউনে গোটা পৃথিবীর ওজন স্তর নেমে গেছে অনেকটাই, এই এক মাসের লকডাউনে কি পৃথিবীর আয়ু কিছুটা হলেও বেড়েছে ? মোহিত রায়: পৃথিবীর আয়ু বলে ঠিক কি আমি জানিনা কিন্তু যেটা হচ্ছে সব জায়গায় মানুষের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য পরিবেশের যে গুণাগুণ অনেক ভালো হয়েছে এটা নিয়ে কোন বিতর্ক থাকতে পারে না, ওজন স্তর আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে কারণ ওজন স্তর যে কারণে খারাপ হচ্ছিল তা রিফ্রেশ হয়ে গেছে, সামগ্রিকভাবে পরিবেশ ভালো হচ্ছে। আকাশে এতো এরোপ্লেন চলাচল করছে না, জলে জাহাজ চলাচল করছেনা আর কলকাতায় সবচেয়ে বড় দূষণের কারণ হলো এখানে তেল -কয়লা, জ্বালানির ব্যবহার, তেলের দাম প্রায় পরেই গেল তেলের বিক্রি নেই বলে। আবারও বলছি যে এটি একটা টার্গেট ঠিক করছে আমাদের সামনে আগামী ডিনার জন্য কারণ লকডাউন তো বেশিদিন চলতে পারে না।

খবরওয়ালাটিভি : আগামী দিনে পরিবেশকে সুস্থ ও সচেতন রাখতে আমাদের কি কি পদক্ষেপ বা সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত বলে আপনার মনে হয়? মোহিত রায়: আমার যেটা মনে হয়, নাগরিক হিসেবে আমরা বলতেই পারি কলকাতা শহরে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে কঠিন কোনো বিষয় নয় যারা এটি নিয়ন্ত্রণ করেন তারা যদি একটু সজাগ হন, তারপর ধরুন বায়ু দূষণ কমানো ! আমরা একটা লোকের কাছে বলতে পারতাম না এগুলো কমালে কি হবে এখন লোকের সামনে বলতে পারি দেখেছেন তো ! কমালে আপনার বাড়ির সামনে এতগুলো পাখি ঘুরে বেড়াতো না এগুলি আমাদের চোখের সামনে উদাহরণ হবে, কত দূর থেকে একটা বাড়িতে শাঁখ বাজানো হতো অন্য বাড়িতে তা শুনতেই পাওয়া যেতোনা, এখন সেটা শোনা যায়। আমার মনে হয় যে পরিবেশকে ভালো রাখতে নতুন করে কোন পদ্ধতি আবিষ্কারের দরকার নেই শুধু যেহেতু আমরা চোখের সামনে দেখতে পেলাম কিরকম দূষণমুক্ত একটা আমাদের পরিবেশ তৈরি হতে পারে সত্যি সত্যিই তৈরি হতে পারে, সেটাই বারবার মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে। আগামী দিনে দূষণ নিয়ন্ত্রণের যে পদ্ধতি গুলো ঠিকঠাক মতন করা হয় এবং যারা এই দায়িত্বে আছেন তারা যেন ঠিকঠাক মতন তাদের দায়িত্ব পালন করেন এই টুকুই বলার।

_______________________________________

২৭/০৪/২০২০
সাক্ষাত্কার নিলেন, রুমকি সরকার