‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তাঁরে বলে গায়ের লোক...’ — নাহ্! একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও কালোকে, কৃষ্ণকলি বলা শুরু হয়নি এখনও। প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিদিন কালোমেয়ের খোটা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয় একাধিককে! গ্রামে-গঞ্জে, অথবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কালো-ফর্সার বিভেদের কাহিনিতেই উত্তাল হয় সিনেমার জগত! চোখে জল আসে, এক একটি কন্যার দুঃখের গল্প দেখে! কিন্তু সেই সিনেমার অন্দরমহলের কাহিনী জানেন? সেখানেও নাকি প্রতিটি মুহূর্তে, সমস্ত দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্যই ডাকা হয় না অডিশনে! সুযোগ তো দূর, আগেভাগেই ফর্সা খোঁজার তাগিদ নিয়ে বারণ করে দেওয়া হয়,অভিনেতাদের?
বাদশার ‘গেন্দাফুল‘ গান বিতর্কের আবহেই, বলিউডের বর্ণবৈষম্য নিয়ে এমনই সব ‘বিস্ফোরক’ অভিযোগ করলেন, ওয়েব সিরিজ ‘স্যাক্রড গেমস’ খ্যাত অভিনেত্রী ঈশিকা দে। ‘খবরওয়ালাটিভি.কম’- কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তুলে ধরলেন এমনই কিছু বিস্ফোরক ‘অভিযোগ’!
—————————————————————–
খবরওয়ালা: আপনি একটি ফেসবুক পোস্টে লিখছেন, ‘কালো বলে আপনাকে যৌনকর্মী অথবা বাড়ির কাজের লোকের চরিত্র দেওয়া হয়।’ এর সঙ্গে জ্যাকলিন বা বাদশার এই গানের কী সম্পর্ক? যেখানে আপনি জ্যাকলিনের ছবিও ব্যবহার করছেন?
ঈশিকা: আমার জ্যাকলিনকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তিনি খুব ভালো অভিনেত্রী। কিন্তু একজন বাঙ্গালি মেয়ের চরিত্রে অভিনয়ে, বাঙালি লুকের মেয়ে সুযোগ পাবেন না? শুধুমাত্র ফর্সা হলেই তাঁদের সুযোগ দেওয়া হবে! আর কালো হলেই আকারে ইঙ্গিতে তাঁকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা হবে? আমার প্রশ্ন এখানেই!
খবরওয়ালা: সেইক্ষেত্রে জ্যাকলিনের দায়?
ঈশিকা: আমি জ্যাকলিনের উদাহরণ দিয়েছি শুধু। তিনি অর্থাৎ জ্যাকলিন নন। এখানে প্রসঙ্গ বর্ণবৈষম্যের! যেখানে একজন কালো মেয়ের সুযোগ থাকে না। তাঁর অধিক ট্যালেন্ট থাকা সত্ত্বেও। শুধুমাত্র ফর্সা হলেই, লালপেড়ে শাড়ি, টিপ পরিয়ে বাঙালি সাজানোর চেষ্টা হবে? এটাতেই আমার আপত্তি।
খবরওয়ালা: আপনিও এর প্রকোপে পড়েছেন?
ঈশিকা: হ্যাঁ! প্রতিমুহূর্তে পড়ি বলেই আজ মুখ খুলেছি।
খবরওয়ালা: মানে?
ঈশিকা: হ্যাঁ! এখনও বহু ভালোমানুষ বাদে, শূন্য থেকে উঠে আসাদের সম্মান দিতে দ্বিধাবোধ করেন অনেকেই। তাই, কালো বলেই বাদ দেওয়া হয়। যদিও কিছু দেওয়া হয়, সেটা হয় কোনও যৌনকর্মী অথবা কোনও বাড়ির কাজের লোকের মতো চরিত্রে। আমার একাধিক সুযোগ আসে, যদিও এমনকিছু করার।
খবরওয়ালা: অর্থাৎ দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও আপনার মতো গায়ের রঙের জন্য বাদ পড়তে হয় অনেককেই?
ঈশিকা: অবশ্যই! আমার অভিনয় দক্ষতা যে আছে, আমি যে অন্য চরিত্রও পেতে পারি, এর বাধা হয়ে যায় আমার গায়ের রঙ! তবে সব চরিত্রই একজন অভিনেত্রী হিসেবে চ্যালেঞ্জিং!
খবরওয়ালা: বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে বাদশার এই গানের সম্পর্ক কী?
ঈশিকা: আছে তো, একজন মানুষের সৃষ্টি, কিন্তু ক্রেডিট নেই তাঁর। তিনি গরিব। আইনি লড়াই হলে, পয়াসার জোরে অনেকেই জিতবেন। তবে, আমার বলার উদ্দেশ্য এই গান না। এটা একটা রূপক মাত্র! একজনের প্রভাব, প্রতিপত্তি, রূপ নেই বলে, তাঁকে হারতেও হতে পারে। এরকমটা প্রতিদিন ঘটে চলে। অডিশনেই ডাক পাই না। ট্যালেন্ট দেখবে কে?
খবরওয়ালা: কিন্তু….
ঈশিকা: (থামিয়ে দিয়ে বলে চললেন) কিন্তু দেখুন, আমার যে চরিত্রগুলো ভাইরাল হল। যৌনকর্মী, জমাকাপড় খোলা দৃশ্য অথবা পরিচারিকা। সবটাই আমার রূপ না, অভিনয়ের জন্য। তাহলে তো আমার অভিনয় দক্ষতা আগে বিচার করা উচিত। গায়ের রঙ নিশ্চয় নয়?
খবরওয়ালা: হ্যাঁ। তবে, বাঙালি-কন্যার চরিত্রে বাঙালিকেই অভিনয় কেন করতে হবে? তাহলে তো, অন্য রাজ্যের জন্যও এই নিয়ম?
ঈশিকা: বাঙালি কন্যার চরিত্রে বাঙালিই অভিনয় করবেন বলছি না। বলেছি, গায়ের রঙের জন্য কেউ অভিনয় করতে সুযোগ পাবেন না, এটা বন্ধ হোক। এখানে দেখা যাচ্ছে, দেখতে বাঙালি মোটেও না, কিন্তু শুধুমাত্র ফর্সা হওয়ার কারণে, পোশাক পরিয়ে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাঙালি চরিত্রে মিলে গেলে, কালো কেন সেটাই অভিনয় করতে পারবেন না? তাঁকেও ফর্সায় হতে হবে!
খবরওয়ালা: অনেক দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী তো বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন?
ঈশিকা: হ্যাঁ! অবশ্যই করেন। আমার লুকে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির মিল থাকলে করব। কিন্তু কেউ যদি উত্তর ভারতের কোনো মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য, আমাকে খোঁজেন, সেটা তো হবে না! কিন্তু বাঙালি-কন্যার চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে কেন একজন বাঙালি কালোমেয়ে সুযোগ পাবেন না! এটা আমাকে অনেক অডিশনে শুনতে হয়েছে। কারণ, সেখানে বাঙালি না, শুধু ফর্সা হওয়াটাই বেশি ইম্পর্টেন্ট!
খবরওয়ালা: পান তো! বিপাশার মতো অনেকেই, বহু কাজ করেন। কাজলের কথা না হয় ছাড়লাম।
ঈশিকা: খুব কম। তবুও কতটা! এরকম সমস্যা তাঁর এখনও হয় কিনা? খোঁজ নিন।
খবরওয়ালা: এই যে মুখ খুলছেন, ভয় পাচ্ছেন না? কাজ পাবেন তো আর?
ঈশিকা: কিছু ভয় নেই! এমনিতেই করোনা আতঙ্কে আছি! যদি মরে যাই, তখন তো বলতেই পারব না। এখন সময়। প্রতিবাদ করার! (হাসি)
খবরওয়ালা: আচ্ছা…
ঈশিকা: আর শুনুন… অনুরাগ কাশ্যপ, নন্দিতা দাস-এঁর মতো বহু মানুষ, এই বাছবিচার করেন না। তাঁরা ট্যালেন্টর মর্যাদা দেন। তাই কাজ নিয়ে ভয় পাই না। এইমুহুর্তেই নন্দিতা দাসের একটা প্রজেক্টের কাজ শেষ হল। সম্প্রতি মুক্তিও পেল। তাতে বহু বিখ্যাত অভিনেতারা আছেন। এই কাজটা মূলত, ডার্ক ইজ বিউটিফুল, এই সংক্রান্ত। যার বিষয় মূলত, ‘ইন্ডিয়াজ গট কালার’, ভারতে একাধিক রঙের মানুষ আছেন। যাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে সুন্দর!
খবরওয়ালা: মুম্বইয়ের কথা বলছেন। কিন্তু কলকাতা কি বর্ণভেদ দেখে না?
ঈশিকা: অবশ্যই কিছুটা তো আছেই! কিন্তু এখানে ঠিকঠাক অডিশন হয় কিনা, না জানা থাকলেও, মুম্বইয়ে কাজের সুযোগ এখনও অনেক বেশি।
খবরওয়ালা: ‘নান্দীকার’ ছেড়ে চলে গেলেন। বিজ্ঞাপন করলেন। ‘স্যাক্রেড গেমসে’র মতো কাজে আপনার সুযোগ এল! তবুও বলছেন, বর্ণবৈষম্য?
ঈশিকা: করেছি। কিন্তু একজন যৌনকর্মী। কাজের লোক। এমন চরিত্র। যদিও সব চরিত্রই ভালো। তবুও! এখনও বহু ফোন পাই, এই ধরনের চরিত্রের জন্য। কিন্তু আমার অভিনয় সত্তার মূল্যায়নের চরিত্র নিয়ে কম ফোন আসে!
খবরওয়ালা: কারণ?
ঈশিকা: ওই যে আগেই বললাম, আমার গায়ের রঙ!
খবরওয়ালা: কী বলছেন?
ঈশিকা: হ্যাঁ! ঠিক বলছি। নিশ্চিত বলছি। এখনও গায়ের রঙেই অনেককিছু বিচার হয়। আপনার যোগ্যতা পরে।
খবরওয়ালা: এই আধুনিকতার সময়েও?
ঈশিকা: জানেন, আমার প্রিয় মানুষরাও বলতেন। ছোট থেকেই, আমার পরিবারের তরফে বলা হত, তুই কালো, তোর বিয়ে হবে না। ছেলে পাব না। তাহলে বাকিরা কেন বলবেন না?…(খানিকক্ষণ চুপ থেকে)… তাই তো, এই গানের প্রসঙ্গেও বললাম। কালোমেয়ের জায়গা নেই! সবেতেই আপনার প্রভাব আর গায়ের রঙই মূল বিচার্য!
—————————————————————
কলকাতার মেয়ে। নাট্যদল ‘নান্দীকারে’ অভিনয়। তারপর ক্রমে ক্রমে মুম্বই পাড়ি। তথাকথিত দাদা, কাকাদের সাহায্য ছাড়াই, একান্তই নিজস্ব কৃতিত্বে পৌঁছে যাওয়া খ্যাতির শিখরে। কিন্তু তিনি যতটা যোগ্য, ঠিক ততটা এখনও পাননি, বলেই দাবি তাঁর। তবুও, নন্দিতা দাসে, কিরণ রাও, নভদীপ সিং, গজেন্দ্র আহিরে’র মতো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ। অনুরাগ কাশ্যপ এঁর কাজে, নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি’র মতো অভিনেতাদের সঙ্গে ‘স্ক্রিন শেয়ার’ও করেছেন তিনি। বিভিন্ন নামী অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছেন। একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভাইরাল হন। পরে ‘স্যাক্রেড গেমসে’র একটি চরিত্রেও খ্যাতিলাভ করেন এই বাঙালি অভিনেত্রী।
—————————————————————–
‘হোম কোয়ারেন্টাইনে‘ রয়েছেন অভিনেত্রী, সেখান থেকেই ফোনে সাক্ষাৎকার দিলেন ‘খবরওয়ালা’র প্রতিনিধিকে।
(সমস্ত সাক্ষাৎকারটি পরিমার্জিত ও ব্যাকরণগতভাবে সংশোধিত।)
৩০ মার্চ, ২০২০
কলকাতা
রিপোর্ট: রমেন দাস
ছবি সৌজন্যে: ঈশিকা দে
©️আর.ডি
khoborwalatv.com