করোনা ভ্যাকসিন ইতিহাসের দ্রুততম আবিষ্কার- “করোনা ভ্যাকসিন”, নরওয়ে থেকে লিখলেন দীপঙ্কর মান্না।

নতুন রোগের বিরুদ্ধে মোকাবিলার উপযুক্ত উপায় ওষুধ অথবা ভ্যাকসিনের আবিষ্কার। বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী, গবেষকরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সন্ধান চালাচ্ছেন নতুনকিছুর। নতুন রোগের বিরুদ্ধে মোকাবিলার উপযুক্ত উপায় ওষুধ অথবা ভ্যাকসিনের আবিষ্কার। বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী, গবেষকরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সন্ধান চালাচ্ছে নতুন ভ্যাকসিনের। কিন্তু কী এই ভ্যাকসিন? বিস্তারিত তথ্য-তালাশ করলেন, নরওয়ে অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি গবেষক দীপঙ্কর মান্না।

_______________________________________

ভ্যাকসিন কি?

ভ্যাকসিন এক ধরনের জৈবিক প্রস্তুতি, যা কোনো নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগের পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে যাতে এটি নতুন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। তাই ভ্যাকসিন তৈরির মূল উদ্দেশ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। ভ্যাকসিন তৈরির একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, রোগ সৃষ্টিকারী কোন নির্দিষ্ট জীবাণুকটাকেই ব্যবহার করা হয় তার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরিতে। অর্থাৎ বাংলা প্রবাদ বাক্যে যাকে বলা হয় ‘বিষে বিষে বিষক্ষয়’।

কিভাবে তৈরি হয় ভ্যাকসিন?

ভ্যাকসিন আবিষ্কার খুবই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। একটা সম্পূর্ণ ভ্যাকসিন তৈরি করতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগতে পারে, এমনকি দশকও। কারণ কোন নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির আগে, সেই রোগের জন্য দায়ী জীবাণু সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নানান বিষয় বিবেচনা করার পরেই শুরু হয় তার প্রস্তুতিপর্ব। প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু হয় নির্দিষ্ট কোনো গবেষণাকেন্দ্রে এবং তার পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সাফল্যের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা হয় সেটা পরবর্তী পর্যায়ে পশুর দেহে পরীক্ষাযোগ্য কিনা। এই পরীক্ষামূলক পদ্ধতিকে বলা হয় ‘প্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’। যেখানে ভ্যাকসিনটি গবেষণাগারে তৈরির পর ইঁদুর বা অন্য কোনো পশুর দেহে প্রয়োগ করে তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার মূল্যায়ন করা হয়। ফল আশাব্যাঞ্জক হলে ভ্যাকসিনটি মানবদেহে পরীক্ষার ছাড়পত্র মেলে, যাকে বলা হয় ‘হিউমান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’। ভ্যাকসিন তৈরি ও পরীক্ষার প্রতিটি পর্যায়ই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়সাপেক্ষ।

ভ্যাকসিন কতটা সুরক্ষিত?

‘সুরক্ষা’ এবং ‘কার্যকারিতা’ ভ্যাকসিন প্রস্তুতির দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক। সুরক্ষা বলতে বোঝায় ভ্যাকসিনটি মানবদেহে কতটা নিরাপদ এবং কার্যকারিতা হল রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা। যে কোনো ভ্যাকসিনের সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা পরীক্ষা করার হয় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়

প্রথম পর্যায় পরীক্ষায়- মূলত ভ্যাকসিনটি মানবদেহে কতটা সুরক্ষিত তার মূল্যায়ন করা হয়। প্রাথমিকভাবে ৪০-৫০ জন সুস্থ সবল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করে ডোজ নির্ধারণ এবং সুরক্ষা বিবেচনা করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায় পরীক্ষায়- কয়েক শতাধিক মানুষের দেহে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতার মূল্যায়ন করা হয়। এই গোষ্ঠীতে বিভিন্ন বয়েসের এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতির লোকেদের ছাড়াও রোগাক্রান্ত ইচ্ছুক ব্যাক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৃতীয় পর্যায় পরীক্ষাটি- সবচেয়ে দীর্ঘতম পর্যায় যেখানে কয়েক হাজার মানুষের দেহে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। এই গোষ্ঠীতে মূলত সংক্রমিত লোকেদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ভ্যাকসিনটি রোগ সারাতে কতটা সক্ষম বা আদেও কার্যকরী কিনা তার মূল্যায়ন করা হয়।

এই তিনটি পর্যায়ের সঠিক পরীক্ষা এবং ফলাফল একটা ভ্যাকসিনের সাফল্য নির্ধারণ করে। যে কোন ভ্যাকসিন তৈরিতে তার সুরক্ষাকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয়।

করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ কেন?

করোনা ভাইরাস একটি নবজাতক ভাইরাস, যার বয়স মাত্র চার মাস। কিন্তু এই চার মাসেই এর ব্যাপক বিস্তৃতি সারাবিশ্বের মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। লাখে লাখে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, সাথে মৃত্যুও। এই কম সময়ের মধ্যে একটা নতুন ভাইরাসের মোকাবিলায় জন্য কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করাও সম্ভভ নয়। তাই বিশ্বজুড়ে সবাই এখন ঘরবন্দি। কিন্তু বিজ্ঞান বসে থাকে না। বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানী আর বিজ্ঞান সংস্থাগুলি দিনরাত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য। একমাত্র ভ্যাকসিনই পারে এর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।

কীভাবে আবিষ্কার হচ্ছে করোনা ভ্যাকসিন?

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয় নি। তাই সারা পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানী, গবেষকরা উঠে পড়ে লেগেছেন সমাধান সূত্রের খোঁজে। পৃথিবীব্যাপী প্রায় ১০০ র বেশী সংখ্যক ওষুধ নিয়ে গবেষণা চলছে। সাথে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজও। মার্চ মাস পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১৫ র বেশী সংখ্যক করোনা ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই এখনো প্রাথমিক প্রস্তুতির স্তরে থাকলেও এই ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় সাতটি সংস্থা শীর্ষস্থানীয়, যার মানবদেহে পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

প্রথম করোনা ভ্যাকসিনের মানবদেহে পরীক্ষা শুরু হয় মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে। মডার্না থেরাপিউটিকস নামক একটি মার্কিন বায়োটেক সংস্থা পরীক্ষাটি প্রথম শুরু করে। এই ভ্যাকসিন পরীক্ষায় প্রথম স্বেচ্ছাসেবীকা ৪৩ বছর বয়সী এক মার্কিন মহিলা, নাম জেনিফার হালের। মাত্র আড়াই মাসের মধ্যেই সংস্থাটি গবেষণাগারে ভ্যাকসিনটি তৈরি করে ফেলে। করোনা ভ্যাকসিন রেকর্ড সময়ে তৈরি করা হয়েছে, যা ভ্যাকসিনর ইতিহাসে এই প্রথম। তবে গবেষণাগারে কোনো ভ্যাকসিন সফল হলে মানবদেহে তার পরীক্ষা সফল হবে, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। মানবদেহে পরীক্ষা পদ্ধতিই সবচেয়ে কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ।

এছাড়া আরও ছয়টি করোনা ভ্যাকসিনের মানবদেহে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। চীনের বায়োটেক সংস্থা ক্যানসিনো বায়োলজিকস, সিনোভ্যাক বায়োটেক এবং একটি সরকারি সংস্থা আলাদা আলাদাভাবে তিনটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু করেছে। অপর একটি মার্কিন সংস্থা ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস, জার্মান সংস্থা বায়োনটেক এবং ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিও সামিল।

এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি ভ্যাকসিনটি। মানবদেহে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষা শুরু হয় এপ্রিলের চতুর্থ সপ্তাহে এবং স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে এগিয়ে আসেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিরই একজন, মাইক্রোবায়োলজিষ্ট এলিসা গ্রানাটো। ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছে এই ভ্যাকসিন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অন্যতম ভ্যাক্সিনোলোজিষ্ট সারা গিলবার্ট ভ্যাকসিনটি নিয়ে খুবই আশাবাদী এবং সব ঠিকঠাক চললে আগামী সেপ্টেম্বর মাসেই এর সাফল্যে পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন। প্রসঙ্গত, গবেষকরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে তাঁরা ইতিমধ্যেই বিপুল সংখ্যক ভ্যাকসিন ডোজ উৎপাদনের ঝুঁকি নিয়েছে, যার সিংহভাগটাই উৎপাদন করবে সেরাম ইন্সটিটিউট নামক একটি ভারতীয় সংস্থা, যা পৃথিবীর বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থা হিসেবে পরিচিত। পরীক্ষা পুরোপুরি সফল হলে সেপ্টেম্বর মাসের কিছু পরেই ভ্যাকসিনটি বাজারে আসতে পারে।

এই সাতটি করোনা ভ্যাকসিন ছাড়াও পৃথিবীর আরও অনেক নামী দামি সংস্থা তাদের নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও বেশকিছু ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হবে মানবদেহে।

কখন বাজারে আসতে পারে করোনা ভ্যাকসিন?

সাতটি ভ্যাকসিন বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে মানবদেহে পরীক্ষাধীন। সব কটি সংস্থাই প্রবল আশাবাদী করোনা ভ্যাকসিনের ভবিষ্যৎ ফলাফল নিয়ে। এই বছর সেপ্টেম্বরের দিকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ভ্যাকসিনটির পরীক্ষা রিপোর্ট আশা করলেও, বাকি সংস্থাগুলো এই বছর শেষ বা আগামী বছরের গোড়ার দিকে সঠিক তথ্য জানতে পারবে বলে জানিয়েছে।

মানবদেহে পরীক্ষা সফল হওয়ার পরই কোনো ভ্যাকসিন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যাবহারের ছাড়পত্র পায়। মাঝখানে কিছু সময় লাগে বৃহত্তর মাত্রায় প্রস্তুতি, বৈধতা বিচার আর গুনগত মান নির্ধারণে। তারপরেই মানুষের হাতে পৌঁছে যাবে জীবনদায়ী করোনা ভ্যাকসিন। তাই সমস্থ পরীক্ষার সফলতা ধরে নিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সঠিক সময়সীমা হিসেব করলে, করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আসতে আসতে আগামী বছর।

যে কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করতে বছরের পর বছর সময় লাগে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী নভেল করোনা ভাইরাসের দ্রুত প্রসার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিতে নেতিবাচক প্রভাব, বিজ্ঞানীদের একত্রিত করে ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে বাধ্য করেছে। করোনা ভ্যাকসিন তৈরি হতে চলছে রেকর্ড সময়ে, যা ভ্যাকসিনের ইতিহাসে প্রথম। উন্নত গবেষণা ব্যাবস্থা, প্রযুক্তির যথাযোগ্য প্রয়োগ আর বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের সহযোগিতা এবং তথ্যের আদানপ্রদান এই সফল্যের মূল কারণ।

লেখক: দীপঙ্কর মান্না
গবেষক, অসলো বিশ্ববিদ্যালয়, নরওয়ে।

০৬.০৫.২০২০