করোনা ভাইরাস – প্রকৃতির প্রতিশোধ? কলমে ডাঃ দীপাঞ্জয় ঘোষ

ড. জেমস লাভলকের নাম অনেকেই জানেন না। ১৯১৯ সালের ২৬শে জুলাই ইংল্যান্ডের হার্টফোর্ডশায়ারে এই রসায়নবিদ ও পরিবেশবিদের জন্ম হয়। পৃথিবী নিয়ে ওনার গবেষণায় একটা বিখ্যাত হাইপোথিসিসের জনক বলা যায় ওনাকে, Gaia hypothesis, যা কিনা গ্রীক পুরাণের পৃথিবীর দেবী Gaia এর নামে নামাঙ্কিত। Gaia hypothesis নিয়ে গবেষণায় লাভলক সাহেবের সহযোগী ছিলেন অণুজীববিদ লিন মার্গুলিস। ১৯৭০ সালে এই হাইপোথিসিস নিয়ে কাজ শুরু করেন দুজনে এবং ২০০৬ সালে জিওলজিকাল সোসাইটি অফ লন্ডন লাভলক সাহেবকে এই হাইপোথিসিসে অবদানের জন্য ওয়ালস্টন মেডেল দেওয়া হয়। Gaia hypothesis নিয়ে খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় যে, এই পৃথিবী আদতে নিজেই একটি সুপার অর্গানিজম এবং অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীরা তার রেগুলেটরি সিস্টেমের এক্সটেনশন মাত্র। এবং এইভাবেই পৃথিবী নিজের জীবন ধারাকে বজায় রাখে। একটা খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যায়। পৃথিবীর আবহাওয়া অন্য গ্রহের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এতে যেমন জীবনধারণের জন্য আছে উদ্ভিদ প্রদত্ত অক্সিজেন, একই ভাবে তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য আছে ব্যাকটেরিয়া প্রদত্ত মিথেন। অন্যদিকে মঙ্গল গ্রহে আবহাওয়া মোটামুটি ভাবে কার্বন ডাই অক্সাইড এই ভর্তি। এই অক্সিজেন ও মিথেনের সহাবস্থানই আজ পৃথিবীকে বাসযোগ্য বানিয়েছে। আমাদের শরীরে উত্তাপ বেড়ে গেলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেমন ঘাম হয়, তেমনি পৃথিবীর তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করেছে পৃথিবীর প্রাণীজগত ও উদ্ভিদজগত। কিন্তু মানুষ প্রতিনিয়ত বন ধ্বংস করেছে, ফুড চেনের বাইরে গিয়ে নিজের আনন্দের জন্য প্রাণী হত্যা করেছে। মোদ্দা কথা, ইকোসিস্টেমকে মানুষ একা হাতে তছনছ করেছে। এখানে একটা প্রশ্ন খুব সহজ ভাবেই উঠে আসে, আমরা, মানে মানুষরা, আদৌ কি পৃথিবী নামক একটা দৈত্যাকার প্রাণের সেল্ফ রেগুলেটরি সিস্টেমের অংশ নাকি আমরা শুধুমাত্র পৃথিবীর কাছে একটা অসুখ? বেশ কয়েক বছর আগে একদল বিজ্ঞানী আরেকটা হাইপোথিসিস নিয়ে আসেন, যা পরবর্তী ক্ষেত্রে প্রচুর ব্যঙ্গের সম্মুখীন হয়৷ আমার স্পষ্টভাবে পুরোটা মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে, তাঁরা বলতে চেয়েছিলেন, মানুষ আদতেই পৃথিবীর প্রাণী নয়। কারণ, তাঁরা যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছিলেন, অন্য প্রত্যেকটি প্রাণীই ইকোসিস্টেমকে মেনে চলে, একমাত্র মানুষই ইকোসিস্টেমকে ধ্বংস করে। ওনাদের মতে, মানুষ হয় কোন বহির্জগতের এক্সটেনশন বা কোন বহির্জগত থেকে নির্বাসিত হওয়া জনগোষ্ঠীর অংশ। কথা শুনলে মনে হয় গাঁজাখুরি, কিন্তু তলিয়ে ভাবলে এটার যুক্তি পাওয়া যায়। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এটাকে ব্যঙ্গ করেছিলেন, কারণ এই তত্ত্ব সরাসরি ডারউইনের তত্ত্বকে অসমর্থন করে। আমাদের কলেজে একজন স্যার ছিলেন, ড. সুব্রত সরকার। স্যার বলতেন, প্রকৃতি খুব চালাক, প্রকৃতির ওপর যতই খোদকারী কর না কেন, প্রকৃতি তার নিজের প্রসেসে নিজেকে ঠিক সারিয়ে তোলে। জানি না, এই করোনার উপদ্রবও প্রকৃতির তেমন কোন খেলা কিনা। তবে দেখা যাচ্ছে,করোনা আক্রান্ত লকডাউন হওয়া শহর গুলোতে পাখির সংখ্যা বেড়েছে, কমেছে দূষণ। ২০১৯ এ আমাজন ও কঙ্গো অরণ্যে আগুন লাগা আশা করি আমরা ভুলিনি। আমরা সবাইই জানি, সেটা মনুষ্যসৃষ্ট দাবানল ছিল। হয়তো এভাবেই প্রকৃতি তার ক্ষত সারিয়ে নিল। আমি বিশ্বাস রাখি, করোনার এই উপদ্রব একদিন আমরা ঠিক নিয়ন্ত্রণ করবই। কিন্তু আমাদেরকেও প্রকৃতির এই সাবধানবাণী বুঝতে হবে। প্রকৃতিকে ধ্বংস নয়, পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। অন্য কারো স্বার্থে নয়, মানবসভ্যতার অস্তিত্বের স্বার্থে। তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া চিত্র সূত্র -লেখক, গুগল