কতটা হাতুড়ি পেটানোর পর শ্রমিক চেনা যায়! মে দিবসে শ্রমজীবী মানুষদের আমাদের তরফে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন।

দিন যায় রাত যায়, প্রতিমুহূর্তে হাতুড়ির ঠকাঠক, আর দৈনন্দিন জীবনের তীব্র ভলোথাকাময় কটাক্ষকে সঙ্গী করেই দিন কাটে ওঁদের। খনির সুরঙ্গ থেকে বেসরকারি কর্পোরেট, শ্রমের কারিগররা থেকে যান খানিকটা একইরকম‌ই। অনেকটা ‘সুকান্তে’র, ‘সিঁড়ি’তে দাঁড়িয়ে হাতুড়ির ঠকাঠাইয়ের মতো। তাই, এদেশ কিম্বা ওদেশ সবেতেই কতটা বদলেছে? রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য সবচয়ে সুলভ উপজীব্যরা?

অনেককাল আগের কথা, একদিন– “পশ্চিম ভার্জিনিয়ার রেল সুরঙ্গে/পাথুরে পাহাড় কেটে কেটে/ রেল লাইন পাতা হবে হেনরীর হাতুড়ির/ঘায়ে ঘায়ে রাত যায় কেটে/হো হো হো হো – ঘায়ে ঘায়ে রাত যায় কেটে!” (গণসঙ্গীত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস)

ঠকঠক হাতুড়ির ঘা পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। একজন কালো চামড়ার শ্রমিক পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ বানাবেই।

সাদা চামড়ার মালিক পক্ষ যদিও মেশিন দিয়ে সুড়ঙ্গ কাটার পক্ষপাতী। কিন্তু শ্রমিকদের নেতা জন হেনরি বাধ সাধলেন। হেনরি জানেন মেশিন এলে এই শ্রমিকদের ভাত মারা যাবে। তাই তিনি বলে বসলেন মেশিনের থেকেও দ্রুত পাহাড় কাটবেন তিনি।

শুরু হল অসম লড়াই। যন্ত্রদানবের সাথে মানবের লড়াই।দিন যায় মাস যায় হাতুড়ির ঘায়ে পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়। যন্ত্রনায় হাত খসে পড়তে চায়। শিথিল হয়ে আসে দেহ। তবু হাত থামেনা। জিততে তাকে হবেই।

হেনরি হারলে শত শত শ্রমিক না খেতে পেয়ে মারা যাবে স্রেফ। দুর্দমনীয় জেদে কাজ করে চলে হেনরি।

অবশেষে জয় হয় মানুষের। মানুষেরই তৈরি যন্ত্রকে স্রেফ প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে হার মানিয়ে দেয় মানুষ। জয় হয় শ্রমিকদের। কিন্তু ততক্ষণে ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা পাড়ি দিয়েছে চিরঘুমের দেশে। তৈরি হয় এক রূপকথার। যে রূপকথা কোটি কোটি মেহনতি মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলে। শোনায় পেশিশক্তি এবং অর্থের কাছে হার না মানার গল্প!

জন হেনরি’ একটি অধ্যায় হলে, ‘মে দিবসে’র নেপথ্যের গল্পটাও অনেক কষ্ট সংগ্রাম, রক্তের গল্প শোনায়। কান পাতলে ভেসে আসে মেহনতি মানুষের অযুত কণ্ঠে ঐকতান। ১৮৮৬ সালে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শিকাগোর হে মার্কেটে জমায়েত হন হাজার হাজার শ্রমিক। অধিকার বুঝে নেবে তাঁরা। মানুষের মত বেঁচে থাকার অধিকার। শ্রমিকদের এই জমায়েতে অশনি সংকেত দেখে মালিক পক্ষ। জমায়েত হটিয়ে দিতে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। মারা যান অন্তত ১০ থেকে ১৫জন শ্রমিক। আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার বদলে আরও প্রবল হয়ে ওঠে। পিছু হটে মালিকপক্ষ। রক্তপাতের বিনিময়ে আসে ঐতিহাসিক বিপ্লব। দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ এবং সপ্তাহে একদিন বিশ্রাম। প্রতিষ্ঠিত হয় ইতিহাস।

এই রক্ত ঝরানো ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতি বছর মে মাসের প্রথম দিনটি পালিত হয়, ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে। পয়লা মে সারাবিশ্বে নানাভাবে পালিত হয় দিনটি।

১৮৮৬ সালের পর কেটে গিয়েছে ১৩০ বছরেরও বেশি। কিন্তু সত্যিই কি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শোষিত, সংগ্রামী, ঘাম ঝরানো মানুষগুলোর জিত হয়েছে? নাকি পুঁজিবাদের যাঁতাকলে আজও প্রতি নিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে তারা? কেমন আছে বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষ। না ভালো নেই তারা। আজও তাঁরা বঞ্চিত, শোষিত, লাঞ্ছিত। ‘মে দিবস’ তো তাঁদের দিন। তবু মজার কথা হল ওইদিন না খাটলে কেউ তাঁদের মুখে খাবার তুলে দেবেনা।

আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্প। আমেরিকায় নারীবাদের বেশ পরিচিত মুখ। কিন্তু তাঁর বস্ত্র বিপননি সংস্থার কারখানাটি কোথায় জানেন ? — তৃতীয়বিশ্বের

দেশ ইন্দোনেশিয়ায়। যেখানে অত্যন্ত কম মজুরিতে মহিলাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এতটাই কম যে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেতে হয়। মাসিক ঋতুচক্র চলাকালীন মেলেনা কোনও ছুটি। এতো গেল পুঁজিবাদের স্বর্গ আমেরিকার মুখোশতন্ত্রের নির্লজ্জ্ব, নগ্ন প্রদর্শন।

কিন্তু তথাকথিত সাম্যবাদের দেশ চীনের হাল টা ঠিক কেমন? –সস্তায় পণ্য উৎপাদনের জন্যে বিখ্যাত চীন। কিন্তু কিকরে এটা সম্ভব করে চীন?

জনদরদী, কমিউনিস্ট চীনে শ্রমিকের মজুরি খুব

খুব কম। দিনে গড়ে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা কাজ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, একপ্রকার কাজ করতে বাধ্য করা হয় তাদের। সুযোগ নেই নিজেদের দাবিটুকু জানানোর। রক্ষিত হয়না তাদের নূন্যতম মৌলিক অধিকার গুলিও। তার থেকে বড় কথা উপায় নেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলার। এই সার্বিক চিত্র কি ১৮৮৬ সালের ঘটনার প্রতিরূপ নয় কি?

ভারতের দিকে চোখ ফেরালেও চিত্রটা খুব একটা স্বস্তি দেয় না।এই উন্নয়নশীল দেশে শ্রম উদ্বৃত। শ্রমিকের চাহিদা নেই, তাই তাঁদের দামও নেই। তাই একটু বেশি টাকা রোজগারের জন্য তাদের যেতে হয় ভিন রাজ্যে। তকমা জোটে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’। এই শ্রেণীর শ্রমিকরা নিজের দেশেই পরিযায়ী। আছে শুধু বেঁচে থাকার অধিকার। যত কম টাকায় যত বেশি শ্রমিক পাওয়া যায় এই হল হিসেব।

নূন্যতম মানবাধিকার চাওয়াও সেখানে বিলাসিতা। এর সবচেয়ে নির্মম বাস্তব চিত্রটি হল, করোনা পরিস্থিতিতে গোটাবিশ্ব সাম্প্রতিক চাক্ষুস করেছে। লক্ষ-কোটি পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফেরার জন্য বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশনে ভিড় জমান। কেউ হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছে পায়ে হেঁটে। নগ্ন পদে, মাথায় বোঁচকা, কাঁধে ঝোলা। এই হতদরিদ্র শ্রমিকগুলির চোখে মুখে বাড়ি ফেরার যে আকুতি তা সভ্য জগতের কাছে ভীষণ লজ্জার। কেউ কেউ পথেই প্রাণ হারান! এ লজ্জা রাখবো কোথায়?

আর, আমার আপনার মত তথাকথিত কর্পোরেট জগৎ? বেসরকারি ক্ষেত্র। প্রতিমুহূর্তে চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা, মাইনে কাটার কষ্ট নিয়েও, আজ স্রেফ পেটের টান আর চাকরির অপ্রতুলতার মধ্যেই কাজ করতে হয় তাঁদের। তাঁরাও তো শ্রমিক?

এইগুলো কেবল টুকরো টুকরো কোলাজ মাত্র। গোটা বিশ্বের ছবিটা কমবেশি একই। এ প্রসঙ্গে নারী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা না বললে ভারী অন্যায় হয়। কেবলমাত্র নারী হওয়ার জন্য, তাদের শারীরিক দুর্বলতার দোহাই দিয়ে কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। তারউপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের লালসার শিকার হওয়া তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব লক্ষ করলে দেখা যায় নির্মাণ শিল্পে নিযুক্ত নারী শ্রমিকরা শাড়ির উপর পুরুষদের পোশাক পরে। পরতে বাধ্য হয়। শুধু নিজেদের আব্রু রক্ষা করার জন্যে!! কবে হিসেব মিলবে? সমকাজে সমবেতন কবে পাবেন তাঁরা??

তাই, ‘মে দিবসে’র দিনে সেই সব মানুষদের কথা ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক যাদের জন্যে এইদিন। তবু তাঁদের অধিকার নেই ভালো ভাবে বাঁচার! সভ্যতার চালিকা শক্তি যাঁরা, তাঁরা আর কতদিন নিষ্পেষিত হবেন সভ্যতার রথের চাকায়? কবে তাঁরা শ্রমিক নন, পূর্ণাঙ্গ মানুষের মত বাঁচার অধিকার পাবেন?

কবে ‘এ পথে আলো জ্বেলে এ পথে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে’? আর কত শতাব্দী পরে? কত ‘মে দিবস’ গেলে তবে আঁধারে ঊষার আলো ফুটবে? লালে লাল হয়ে প্রভাতের দিবাকর উদিত হবেন?

প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও রাষ্ট্রের জানা নয় কি?কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে গাইতি, হাতুড়ির গান?

লেখা: স্বাতী সেনাপতি