”তেরি উম্মিদ, তেরা ইন্তেজার করতে হে, এ সনম হাম তো সির্ফ তুমসে পিয়ার করতে হে…”, নাহ্! তোমার আশা, তোমার ফিরে আসার তাগিদ থাকলেও, শুধু তোমাকেই ভালোবাসলেও, তুমি আর এলে না। মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর সমস্ত ভালোবাসাকে নিয়েই পাড়ি দিলে এক অজানা দিগন্তে। চলে গেলে সমস্ত ভালোরাখাকে একা করে। কী আশ্চর্য সমাপতন! এমন ঠিক কবে ঘটেছিল আমরা হয়তো খুব কম বলতে পারব!
মাত্র ২৪ ঘণ্টা! হ্যাঁ, এই সময়টুকুও কাটেনি। কিন্তু এরমধ্যেই একপ্রকার আকস্মিকতার বিস্তার ঘটিয়েই, ভারতীয় সিনেমা জগতের এক নয়, দুটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হারিয়ে গেল চিরকালের জন্য। ইমরান খানের মৃত্যুর শোক স্তব্ধতা কাটার আগেই, ফের দেশবাসীর উদ্দেশে এক কঠিন শোকের সৃষ্টি করে দিলেন কাপুর সাম্রাজ্যের আরেক নক্ষত্র ঋষি কাপুর। আজ সকালেই মুম্বইয়ের এইচএন রিল্যায়ান্স ফাউন্ডেশন হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। ছেড়ে গেলেন স্ত্রী, কন্যা, পুত্র সঙ্গে অগণিত ভক্তকে। কী আশ্চর্য সমাপতন! যে ইরফান খান কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২০১৮ সালে, সেই একই বছরেই আক্রান্ত হন ঋষি কাপুরও। আর তাঁদের মৃত্যু! কয়েকঘন্টা র ব্যবধানে। পান সিং তোমার মুহূর্তের মধ্যেই নিজের কাছে টেনে নিলেন ‘জোকার’কে। মাত্র ৬৭ বছর বয়সেই বিদায় নিলেন ঋষি।
বলিউডের এই অভিনেতার মৃত্যুতে স্বাভাবিক ভাবেই শোকস্তব্ধ গোটা দেশ। স্বপ্নেও যা কেউ ভাবেননি, এত কমসময়ে দুজনের চলে যাওয়ার কথা! তা ভেবেই শিহরিত হচ্ছেন তাঁরা। অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, বন্ধু বিদায়ের শোকে লিখছেন, ‘আমি ভেঙে পড়েছি, ঋষি নেই !’ বলিউডের তারকারা বিস্ময়ের সঙ্গে শোকপ্রকাশ করছেন আজ আবার। অবাক সকলেই। রাজনৈতিক মহল থেকে বিশিষ্ট জগতের সকলে জ্ঞাপন করেছেন শোক। রাহুল গান্ধী বলছেন, ‘ভারতীয় সিনেমার এক ভয়ঙ্কর সপ্তাহ!’
আসলে, এই মুহূর্তে যেন নানা ঘটনার সাক্ষী, মধ্যগগনে থাকা ২০২০ সালটা। করোনা ভয়াবহতা আবার নক্ষত্র পতন! যেমন, জীবনের মধ্যভাগে সদ্য বিদায় নেওয়া সিনেমা জগতের একজন ইরফান খান, আর এরই মধ্যে আবার সিঁদুরে মেঘ দেখে বলিউড। বুধবার জানা যায়, গুরুতর অসুস্থ হয়ে, হিন্দি সিনেমা জগতের প্রবীণতম অভিনেতা তথা কাপুর পরিবারের কর্তা ঋষি কাপুর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানান তাঁর ভাই রণধীর কাপুর। রাতেই জানা যায়, তাঁর অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক, এমনকি আইসিইউতে আছেন ঋষি কাপুর, এমনটাই জানান তাঁর ভাই রনধীর কাপুর। অবশ্য বুধবার থেকে নয় গত সাতদিন ধরেই নাকি মুম্বাইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ঋষি কাপুর এমনটাই জানা যায় সূত্রে। রণবীর কাপুর তাঁর বাবার অসুস্থতা নিয়ে তখন অবধি কিছু জানাননি।
আসলে, ২০১৮ সাল থেকেই সময়টা কাপুর পরিবারের পক্ষে সুখকর ছিল না, এই সালেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে কাপুর ফ্যামিলির উপর, ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ঋষি কাপুর। অতঃপর চিকিৎসার জন্য ছেলে ও স্ত্রী তাঁকে নিয়ে পাড়ি দেন নিউইয়র্কে। ২০১৯ – এ কিছুটা স্বস্তি মাথায় নিয়ে প্রায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন ঋষি কাপুর। কিন্তু সে ফেরা আবার তাঁকে টেনে নিয়ে যায় অসুখের জগতে। আবারও এবছরের ফেব্রুয়ারীতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।
গোলগাল সদাহাস্য মুখ নিয়ে সর্বদাই অনুরাগীদের সংস্পর্শে থাকতে পছন্দ করতেন তিনি, বয়সকে কখনোই তোয়াক্কা করেননি, অসুস্থতাতার মধ্যেও চলতি লকডাউনে টুইট করে মানুষের মনোবল বাড়িয়ে হাসিয়েছেন তিনি। চিকিৎসকদের আক্রমণ করতে বারণ করেছেন। গত ২ এপ্রিলের পর এই অভিনেতার হাসিখুশি উপস্থিতি আর অনুভব করেননি তাঁর ভক্তরা। সব সুখের অনুভূতি পেছনে ফেলে আজ তিনি চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন! মুম্বাইয়ের এইচ.এন রিলায়েন্স হাসপাতালেই শেষ হল একটা যুগ। সমগ্র দেশ, তাঁর ভক্তরা অধীর আগ্রহে তার সুস্থতা কামনা করে অপেক্ষা করলেও আবার কবে তাঁদের প্রিয় অভিনেতার উজ্বল উপস্থিতি অনুভব করবে, এমনটা ভাবলেও তা আর হল না।
সালটা ছিল খুব সম্ভবত ১৯৭৪, কুড়ির গন্ডি পেরোনো সেই কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটা, ‘মেরা নাম জোকার’ দিয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ করা সেই ছোট্ট ছেলেটা। কে ভেবেছিল ওই বয়সেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে জিতে নেবেন জীবনের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অবশ্য তাঁকেই তো মানায় যাঁর অভিনয়ের নেশা রক্তেই ছিল ছোটবেলা থেকে। ঠাকুরদা পৃথ্বীরাজ কাপুর হয়তো গোটা পরিবারকে অভিনয়ের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, মুম্বাইয়েরম্বাইয়ের চেম্বুর শহরের একটি পাঞ্জাবি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি, তাঁর জন্মসূত্রে নাম ঋষি রাজ কাপুর। জাত অভিনেতা রাজ কাপুরের দ্বিতীয়পুত্র ঋষি কাপুর, অভিনয়ে দক্ষতা থাকাটা অবাকের কোন বিষয় নয়। তাঁর স্কুলজীবনের হাতে খড়ি মুম্বাইয়ের ক্যামসন স্কুল থেকে, তারপর আজমির মায়ো কলেজ থেকে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন, এই পর্যন্ত ছন্দপতন ঘটে শিক্ষা জীবনের।
জীবনের মোড় পাল্টে, পাকাপাকিভাবে তিনি প্রবেশ করেন অভিনয়জগতে| দাদা রনধীর কাপুর ও ছোট ভাই রাজীব কাপুরের সিনেমাজগতে অভিষেক হলেও তাঁরা কেউই ঋষি কাপুরকে ছুঁতে পারেনি অভিনয়ের দৌড়ে।
ব্যক্তিগত জীবন তাঁর বরাবরই কেটেছে অত্যন্ত সুখে ও স্বাচ্ছন্দ্যে। সহ অভিনেত্রী নিতু সিং-কে ১৯৮০ সালে বিয়ে করেন ভালবেসে। যাঁর সঙ্গে ১২ টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। সুখী দম্পতির দুটি সন্তান, অভিনেতা রণবীর কাপুর এবং মেয়ে রিধিমা কাপুর সাহানি, তবে রিধিমা অবশ্য পরিবারের ধারা বজায় না রেখে ডিজাইনার হওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন।
ঋষি কাপুরের অভিনয়ের সিঁড়িতে পরিণত হয়ে ওঠা ‘ববি’ সিনেমা দিয়ে, ডিম্পল কাপাডিয়ার সাথে সেই দুষ্টু-মিষ্টি প্রেম, পর্দায় সেই অনাবিল টিনেজার ভালোবাসা মন কেড়েছিল সবার। তারপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘ববি’-র জন্য ১৯৭৪ সালে ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন তিনি। তারপর আত্মপ্রকাশ ‘কর্জ’ সিনেমা দিয়ে, পর্দায় নাচের তালে পা কাপানো ‘কেয়া তুমনে কাভি কিসিসে পেয়ার কিয়া’ বলা ছেলেটা, হ্যাঁ ভালোতবেসেই ফেলেছিল সিনেমাপ্রেমীরা সেই উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত ছেলেটাকে। অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ দিয়েও শান্ত হননি তিনি, নাচের জগতে একটা অন্য ছাপ রেখেছেন ‘চাঁদনী’ -র সেই রোমান্টিক ছেলেটি। জয়াপ্রদার সাথে ‘সরগম’ ছবিতে ডফলি নিয়ে ঘুঙুরের তালে সাবলীলভাবে পা মিলিয়ে নেচেছেন তিনি। মন কেড়েছেন সিনেমা জগতের চিত্রপরিচালকদের। একের পর এক সিনেমা বাড়তে থাকে তার অভিনয় জগতের ঝুলিতে । ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি ৯২ টি ছবিতে অভিনয় করেন, তার মধ্যে ৪১ টি চলচ্চিত্রে হিরোর চরিত্রে অভিনয় করেন, তখনকার সময় কার এমন কোনো অভিনেত্রী বাদ যাননি যে তাঁর সঙ্গে পর্দায় অভিনয় করতে ইচ্ছে প্রকাশ করেননি। এমনকি উঠতি অভিনেত্রী জুহি চাওলার সঙ্গে ‘বোল রাধা বোল’ সিনেমার পর্দায় ভালোবাসার আবেগে কোমর দুলিয়েছেন মধ্যবয়স্ক ঋষি কাপুর।
‘দিওয়ানা’ সিনেমায় মাঝবয়সী কনিষ্ঠ অভিনেত্রী দিভিয়া ভারতীর সাথে সাবলীল অভিনয় তাঁর বয়সের ছাপকেও টেক্কা দিয়ে ফেলেছিল। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তার সহধর্মিনী নিতু সিং এর বিপরীতে মোট বারোটি চলচ্চিত্রে একসাথে কাজ করেন | অবশ্য অভিনয় জগতের প্রথম দিকটা খুব মসৃণ হলেও মাঝে এসে সফলতা হাত বাড়ায়নি তাঁর দিকে| তাঁর ভারাক্রান্ত চেহারার ফলে ৯২ টি চলচ্চিত্রের বাকি ৫১টি চলচ্চিত্রের মধ্যে মাত্র ১১টি চলচ্চিত্রে তিনি সফলতা পান।
তারপর বয়সের আধিপত্য বেড়ে যাওয়ায় আর ফিরতে পারেননি হিরোর চরিত্রে। অভিনয়ের বিষয় পরিবর্তন করে কমার্শিয়াল ধারায় অভিনয় করেন তিনি| ২০১৩ সালে অগ্নিপথ সিনেমার রিমেকে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করে নিজের হিরোর তকমা ভেঙে হয়ে ওঠেন শ্রেষ্ঠ ভিলেন, সেরা ভিলেনের চরিত্রে পুরষ্কার পান ফিল্মফেয়ার চলচ্চিত্র উৎসবে| একটা সময়ের পর তথাকথিত মিষ্টি রোমান্টিক ছেলের সাজটা মুছে ফেলে যত অভিনয় জগতের দিকে এগিয়েছেন পরিণত হয়েছে তাঁর অভিনয় ক্ষমতা। ‘কপূর এন্ড সন্স’ ছবিতে একশো বছরের গ্র্যান্ড পা- এর সেই দুষ্টু-মিষ্টি চরিত্রে নতুন ভাবে তাঁকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছেন দর্শক।
দু’বছর আগে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘১০২ নট আউট’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন বলিউডের বিগ বি অমিতাভ বচ্চনের সাথে| অবাকের বিষয় হলো ঋষি কাপুর বিগ-বির বয়স্ক ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যা অভিভূত করেছে সকলকে| সিনেমাপ্রেমীদের দুর্দান্ত অভিনয়ে মাতিয়েছেন বাবা-ছেলের এই বয়স্ক যুগলবন্দী। তবে ভয়ঙ্কর রোগ ক্যান্সারের গোলোকে প্রবেশ করে আর সিনেমা করা হয়নি তাঁর, সাময়িকভাবে ইতি টেনেছেন অভিনয়ে।
২০০৯ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য রাশিয়া সরকার সম্মান প্রদান করেন তাঁকে, এর পাশাপাশি, ২০১০ সালে অপ্সরা ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন প্রযোজক ও একই সালে ‘লাভ আজ কাল’ ছবিতে সহ-অভিনেতা হিসেবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান| ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে অবদানের জন্য লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে ২০১৬ সালে ভূষিত করা হয় তাঁকে।আরো বহু সম্মান রয়েছে তাঁর অভিনয় জগতের ঝুলিতে।
সেই প্রাণের ‘চিন্টু জি’ আজ শয্যাশায়ী। এতটা অন্ধকারের মধ্যেও একটা আশা, আবার সেই প্রাণবন্ত গোলগাল মুখের মানুষটি ফিরে আসবেন সবার কাছে, হাসিখুশি চেহারা নিয়ে মজা করবেন, আরো অনেক অভিনয় উপহার দেবেন, কারণ অভিনেতাদের যে বাঁচতেই হয় অভিনয়ের শিল্পে
সে, পর্দায় হলেও, বাস্তবে বুঝি ওই চার দেওয়ালের কামরার বিছানায় শুয়ে অভিনয় করা হয়না। ওই পর্দার মানুষটিকে একবার কাছে পেতে চায়, ছুঁতে যায় অসংখ্য অনুরাগীরা, তাই হয়তো বারবার শিল্পীদের ফিরে আসতে হয় মৃত্যু যুদ্ধকে হারিয়ে অন্যরূপে, অন্য ধারায়। হয়তো তাঁর পার্থিব শরীর আজ নেই, ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন তিনিও কিন্তু থেকে গেল তাঁর সৃষ্টি, তাঁর ভালো রাখার সমস্ত উপজীব্য…!
তাইতো, ”তেরি উম্মিদ, তেরা ইন্তেজার করতে হে, এ সনম হাম তো সির্ফ তুমসে পিয়ার করতে হে…”
৩০.০৪.২০২০
_________________________________
লেখা: রুমকি সরকার