এক অসহায় নারীর শেষ হওয়ার গল্পই কি হোলি?

বাংলায় দোল। কোথাও আবার হোলি। কোনদিন হোলি আর কোনদিন দোল, তা বরাবরই শুভেচ্ছা জানাতে গুলিয়ে ফেলেন নেটিজেন’রা। শুভেচ্ছার বন্যায় দোলের দিনও চলভাষের ইনবক্স ভরে যায় ‘হ্যাপি হোলি’তেই।

রঙের উৎসবে মাতোয়ারা হওয়া ছাড়া এই শুভেচ্ছা জানানোর ভুলত্রুটি খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটে চলেছে যুগ-যুগান্তর ধরে। কিন্তু মঙ্গলবার দেশজুড়ে হোলির আগেই একটু কি জানতে ইচ্ছা করে না, কীভাবে সৃষ্টি হল এই হোলি? কেন এল এই উৎসব?

বঙ্গে রাধাকৃষ্ণের দোল খেলা, অথবা কৃষ্ণের কুর্মী অসুরকে বধ করে, অশুভ শক্তিকে বধের আনন্দে রঙের উৎসবে মেতে ওঠার কাহিনী থেকে মহাপ্রভু চৈতন্যের দোল উৎসব। বিশশতকের রবীন্দ্রনাথের বসন্ত উৎসবের ধারণা, বঙ্গের দোল নিয়ে পুরাণ থেকে হাল আমলের ভাবনা, ভিন্নতায় ভরপুর রয়েছে সব।

তবে এই দোল ছেড়ে যদি হোলির উৎসবের দিকে নজর দিই, তাহলে পুরাণ অনুযায়ী স্পষ্টতই দেখা যায়, যুগ যুগ ধরে হোলি নিয়ে রয়েছে এক ইতিহাস।

স্কন্ধপুরানের ফাল্গুন মাহাত্ম্যের হোলিকা-প্রহ্লাদ

কাহিনী অনুযায়ী জানা যায়, কাশ্যপ আর দীতির পুত্র হিরণ্যকশিপু বরাবরই স্বর্গের দেবতাদের বিরাজ ভালো চোখে নেননি। দেবতাদের দিক থেকেও ছিল অশান্তির উৎসাহ। একটা সময় দীর্ঘ সাধনার পর ব্রহ্মার আশীর্বাদে কিছু ক্ষেত্র বাদে অমরত্বের বর অর্জন করে নেয় সে। কিন্তু গোল বাধে তাঁর পুত্র প্রহ্লাদকে নিয়ে। পিতার মতো সে অধার্মিক নন। ধর্মে তাঁর মন প্রাণ। এই সমস্যার মধ্যে, বৈপরীত্যের মধ্যে তীব্র ক্রুদ্ধ হয়

হিরণ্যকশিপু। নিজেকে দেবজ্ঞানে পুজো করার ইচ্ছা থাকলেও, প্রহ্লাদ তা মানেনি। একদিন সর্বসম্মুখে তাঁর বোন হোলিকাকে ব্যবহার করা হয়। আগুনে কোনও ক্ষতি না হওয়ার শক্তি বা বর নিয়েই, হোলিকা ভাইপো প্রহ্লাদকে কোলে করে প্রবেশ করে আগুনে। বিষ্ণুর কৃতিত্বে প্রহ্লাদ অক্ষত বেরিয়ে আসতে পারলেও, সমস্ত ক্ষমতা শেষ হয় হোলিকার। পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় সে। শান্তি আসে স্বর্গ জুড়ে। হেরে যান হিরণ্যকশিপু।

এদিকে শুধু স্কন্ধপুরাণ না, নারদ সংহিতা (গীতা প্রেস, নবম সংস্করণ, পাতা- ২১৮) ভগবৎ পুরাণ (গীতা প্রেস, দ্বাদশ সংস্করণ, পাতা ১৪৫) – এ এই কাহিনী বর্ণিত আছে। ভক্ত সুমতি, রত্নাবলি, দশকুমার চরিত, প্রহ্লাদ উপাখ্যানের মতো সংস্কৃত নাটকেও এই কাহিনীর কথা জানা যায়। সারা দক্ষিন ভারত সহ মধ্যভারত ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোককথা, লোকমুখেও এই কাহিনীর কথা বলা হয়েছে। বর্ণিত কাহিনীর আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের বিচারে কেউ কেউ এই কাহিনীতে আর্য – অনার্যের সংঘাতের কথাও বলেন।

কিন্তু পুরাণ থেকে চোখ সরিয়ে যদি এই যুগের আবহমানতায় আমরা বিচার করি, তাহলে বোঝা যায়, এক পুরুষের উপর আরেক পুরুষের প্রতিশোধস্পৃহা, আর সেই আক্রোশ মেটাতেই ‘দাবার চাল’ বা ‘টোপ’ করা হল এক নারীকেই। কুৎসিত, খারাপ রূপের বা ভালো রূপের চরিত্র হলেও পুরাণ‌ও যেন বারবার ব্যবহার করেছে নারীকেই। এক্ষেত্রে, সবার সব ‘বর’ কাজ করলেও, হোলিকার সময়ে তা আর কাজ করে না। আগুনে পুরূষের ভস্ম ওড়ার কথা থাকলেও, নিমেষেই শরীর শেষ হয় এক নারীর। মৃত্যু হয় হোলিকার। দাদার কথা রাখতে, শক্তিশালী এক পুরুষের কথা রাখতে, শৌর্য-বীর্যের মাহাত্ম্য রাখতে, আগুনের সামনে যেতে হয় তাঁকে।

পুরাণ কথায়, রামায়ণের রাবণ ছাড়া খুব সংখ্যক জায়গাতেই পুরুষের ক্ষতি কম হয়েছে, মৃত্যুর মুখোমুখি কম হয়েছেন তাঁরা। এই রামায়নেও স্বামীর ইচ্ছায়,স্বামীর প্রজাদের সামনে স্ত্রীর সতীত্বের প্রমাণ দিতে দিতেই বিলীন হতে হয়েছিল সীতাকে। সূর্পনখার নাক কেটে অপরাধ করা লক্ষণের দায় নিতে হয়েছিল রাম না সীতাকে। সেদিনও পুরুষের দায় নিয়েই মরতে হয়েছিল তাঁকেও।

আদতে, এক অনার্য ফাঁদে পা দেওয়া নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে হোলি উৎসব পালন করা মানবিক কী করে হয়? তাই হোলির থেকে দোলই বোধহয় খানিকটা ভালো। আর্য দেবতারা অনার্য এক রাজাহিরণ্যকশিপুর রাজত্ব আক্রমণ, অনেকটা মেঘনাদ হত্যার মতো তাঁর সেনাপতিকে হত্যা করা।

রামের স্ত্রী অপহরণের মতো, দেবতারা খলনায়কের মতো ভূমিকা পালন করে, দেবতারা। দেবতাদের আশ্রমে জন্ম নেওয়া প্রহ্লাদের দেবতা প্রীতি মানতে পারেননি তাঁর পিতা। ক্রমশ বাড়তে থাকে প্রতিশোধ পরায়ণতা। কিন্তু সেই প্রতিশোধ, সেই শত্রু নিধনে সহজলভ্য সেই নারীই।

বুদ্ধিমতি, রাজত্ব পরিচালনায় সুদক্ষ, যুদ্ধকৌশলী এবং প্রজা কল্যানকামী নারী। দাদার স্নেহভাজন হলেও, টোপ কিন্তু সেই হোলিকায়। শুধু দাদার ভুলই নয়, দেবতাদের চক্রান্তেও অচিরেই উপজীব্য হতে হয় তাঁকেই।

যদিও হোলিকার মৃত্যু নিয়ে, দেবতাদের দ্বারা অপরহণ, আগুনে পুড়িয়ে ফেলার জনশ্রুতি থাকলেও, আদতে স্কন্ধ পুরাণের কাহিনীকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।

কিন্তু এইযুগে দাঁড়িয়েও, এই কন্যা বাঁচানোর সময়ে দাঁড়িয়েও হোলিকা দহনের পরেই এতে উঠতে থাকি আনন্দের উৎসবে। আনন্দে ভরিয়ে তুল তে থাকি সব। কারণ অশুভ নিধন হয়েছে। সত্যিই কি অশুভ নিধন হয়েছে? হোলিকা অশুভের প্রতিনিধি নাকি আজীবন দলিত নারীর প্রতিনিধি? প্রশ্ন কিন্তু ওঠেই।

আসলে বারবার এখানে, হোলিকাকে অশুভ শক্তির নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। হিরণ্যকশিপুর অত্যাচারে অতিষ্ট দেবতারা, সাজিয়ে গুছিয়ে আগুনের দিকে ঠেলে দিয়েছেন এক নারীকেই। আর প্রভাবশালী দাদা, বোনের ‘ইমেজে’র ব্যবহার করে, সন্তান অর্থাৎ রাজার শত্রুকে পথ থেকে সরাতে নিজের বোনকেই করে তুলেছেন এক উপজীব্য। যা প্রতিশোধের উপজীব্য। আর সেই ঘটনাকে সঙ্গী করেই, দিনের পর দিন সেই মহিলাকে অশুভ শক্তির প্রতীক বানিয়ে পুড়িয়ে, পরের দিন আনন্দ উদযাপন করছি।

অবাঙালিদের মধ্যে এই তুলনায় হোলিকা দহনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বুড়ির ঘর আর সেই ঘরের বুড়ি পুড়িয়ে, ন্যাড়াপোড়াকরার মধ্যে কিন্তু দোলের প্রসঙ্গ আছে, সেখানে হোলিকা উৎস হলেও, সেই প্রসঙ্গ খুব কমই আসে। অশুভের বিনাশের তীব্র আগুনের দহন আর পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখা হয় মূলত। কিন্তু হোলিকার ছারখার হয়ে ওঠা সর্বাধিক ভিন রাজ্যের হোলির সঙ্গেই জড়িত।

বরাবরই পুরুষতান্ত্রিকতার যুগে প্রভাবশালী পুরুষের দায় আর পুরুষের প্রতিশোধের টোপ এক নারীর হয়ে ওঠা, চিন্তার উদ্রেক করে বইকি।

আর সেই ঘটনাকে ধরেই যেন এখনও এগিয়ে চলে শিক্ষিত সমাজ। প্রহ্লাদ বাদেও, সেই হিরণ্যকশিপুও ভগবান জ্ঞানে পূজিত হন বারবার। এখনও পুজো পান তাঁরা। কিন্তু শুধুই বর্জিত হোলিকা? বিনা দোষে বোনের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে, মৃত্যুবরণ করা হোলিকা? এখনও অশুভের প্রতিনিধি হিসেবে পূজিত না, পুড়ে ছারখার হন বারবার। ফের যেন প্রশ্ন ওঠান, শত সহস্র বছর আগেও আমরা যা ছিলাম, এখনও আছি তাই, ‘পুরুষ তুমি পুরুষ তিনি,সব পুণ্যে তোমাকেই পাওয়া যায়।’ তাই যেন বারবার, হোলিকার মতো হাজারো মেয়ে পুড়তে পুড়তে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু ডাক শোনেনা কেউ! শুধু বারবার সবকিছুর শেষে তাঁদের কষ্টের ইতিহাসের ছাঁইয়ের উপরেই হেঁটে যায় কোটি কোটি মোমবাতির মিছিলের পায়ের ছাপ!

হ্যাপি হোলি!

#হ্যাপি_হোলি

০৯-০৩-২০২০

PC: Tweeter

by Ramen Das