নয়াদিল্লি: ‘আজকের এই সূর্য দেশের মেয়েদের, ইনসাফের। লড়াই থামেনি, যে মেয়েরা এখনও ইনসাফ পায়নি, ওদের জন্য লড়ব,’— মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় দাঁড়িয়ে বলছিলেন নির্ভয়ার মা আশা দেবী। ছলছল চোখ নিয়েই যেন বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, অবশেষে তিনি জিতেছেন। দেশের মানুষ জিতেছেন। শেষমুহূর্তে অপরাধীদের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেও, তা খারিজ হওয়ার পর এমনই মন্তব্য করেন তিনি। যদিও আজ ভোরেই নতুন সূর্য উঠেছে। ৭ বছর পর, নির্ভয়ার খুনিরা ফাঁসিতে ঝুলেছে। এপি সিংয়ের বহু চেষ্টার পরেও, বাঁচেনি অপরাধীরা!
আসলে,আফজল গুরু! আমির আজমল কাসভ! এবার, মুকেশ সিং, অক্ষয় ঠাকুর, পবন গুপ্তা, বিনয় শর্মা!—– মৃত্যু অনভিপ্রেত! কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু সুখ আনে, ইচ্ছা না হলেও অযাচিত শান্তি আনে মনে। উপরিউক্ত প্রথম ওই দু’টি নাম দেশবাসীর প্রায় সকলের মনেই, একপ্রকার শান্তি এনেছিল। এবার ‘করোনা শত্রু’র নিধনের লড়াইয়ের মধ্যেই, ওই চার ‘নির্ভয়া শত্রু’র নিধন নিশ্চিতের খবরে খানিক স্বস্তি, দেশের ১৩০ কোটি জনতার অধিকাংশের মনেই। এইভেবেই নিশ্চিত, ‘অবশেষে বিচার পেল নির্ভয়া।’ দীর্ঘ ৭ বছরের যুদ্ধের পর, জয় আশাদেবীর। জয় পেলেন তাঁর পরিবারের লোকেরা। কন্যার অথবা বোনের মৃত্যুর দগদগে ক্ষততে খানিক প্রলেপ লাগানোর পালা।শুক্রবার ভোরেই এল সেই সময়।
অপরাধীদের পক্ষের আইনজীবী র শেষ চাল। মাঝরাতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন। রাত ২.৩০ টা থেকে শুনানি। ফাঁসির পরিস্থিতি নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলছিল। কিন্তু শীর্ষ আদালতের তরফে সবটাই খারিজ করে দেওয়া হয়। রাত ৩.৩০ টে নাগাদ নিশ্চিত হয়, তিহারেই রচিত হল নতুন ইতিহাস। সত্যিই ফাঁসি। একসঙ্গে ফাঁসি হল চারজনের। কিন্তু ওই রাতেই, অপরাধীদের আইনজীবী অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে, তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান এক মহিলাও।
কিন্তু এবার আর বাধা থাকে না। আজ, শুক্রবার, ২০ মার্চ, ভোরের আলো ফোটার আগেই সাজানো ফাঁসি-শয্যায় শায়িত হল, নির্মম নির্যাতনের ওই মূল কারিগররা। একসঙ্গেই, তিহার জেলে, ফাঁসুড়ে পবনের হাতেই ঝুলল ওই অপরাধীরা। যত্নের দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হল, আশাদেবীর চোখের জলের ‘কারণ’দের।— যেন, এমনই অনুভূতি দেশবাসী জনতার বড় অংশের। ফাঁসির খবরে উচ্ছসিত তাঁরা। বারবার তিনবার, পিছিয়ে যাওয়ার পর, স্বাভাবিকভাবেই আজকের এই সকালের পর খুশি জনতা। আট থেকে আশির একটাই কথা, ‘করোনা’ চিন্তার মধ্যেই এই খবর সত্যিই স্বস্তি দিচ্ছে।
বিমলচন্দ্র সেন, বেসরকারি দফতরের কর্মী, তিনি বললেন, “দেখুন এতবছর অপেক্ষা করছি। এরমধ্যে কত নোংরা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু করোনা করোনা ভয়ের মধ্যেও, আজকের রাতটা ভালো ঘুম হবে।” এক কন্যাসন্তানের মা, স্কুলশিক্ষিকা মোহিনী দেবী (নাম পরিবর্তিত) জানালেন, “দিনের পর দিন চিন্তায় থাকি, আমার মেয়েকেও ভালো দিন উপহার দিতে পারব তো? কিন্তু এই ফাঁসি দৃষ্টান্ত হবেই, অন্তত পিশাচগুলো এসব করলে সাতবার ভাববে।” একই কথা, বৃদ্ধা অঞ্জনাদেবীরও। আর কলেজ-পড়ুয়া সৈকত বললেন, “লজ্জা লাগত! এদের মা বোন ছিল না? পুরুষ জাতির কলঙ্ক। ওদের প্রকাশ্যে মারলে ভালো হত, কিন্তু এটা আদেও হল এটাই যথেষ্ট।”
যদিও, ফাঁসির পক্ষে সওয়াল করে না কোনও মানবাধিকার সংগঠন। তবে এই ফাঁসি নিয়ে, দেশের মানুষের আবেগের কথা চিন্তা করে, এখনও খুব একটা কিছু বলেনি কোনও সংগঠন।
প্রসঙ্গত, একবার ২২ জানুয়ারি! তারপর ১ ফেব্রুয়ারি! অবশেষে ৩ মার্চ! তারপর ২০ মার্চ! এগুলো ৭ বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের অপরাধীদের ফাঁসির তারিখ। প্রথম তিনটি দিন, তারিখ পে তারিখের যাঁতাকলে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে দিন ধার্য হয় ২০ মার্চ, সকাল ৫.৩০ মিনিট। কিন্তু ফের অপরাধীরা আবেদন করে কোর্টে। দিল্লি হাইকোর্ট এই আবেদন খারিজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে। আগেই এই অপরাধীরা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতেও আবেদন করে। এদিকে, ক’দিন আগেই, তিহার জেলে এই ফাঁসির ঘটনা যখন প্রায় নিশ্চিত হতে চলেছে, তখন ফের নতুন বাহানা খুঁজে বের করে এক অপরাধী মুকেশ সিং। দিল্লির আদালতে তার আইনজীবী এক ‘আজব’ দাবি করে বসেন। বলেন, দিল্লির ওই ঘটনার সময় নাকি মুকেশ উপস্থিতই ছিল না। তিনি তখন ছিল রাজস্থানে।
ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়ার এই নতুন ‘অজুহাতে’ বেশ অবাক হন আইন মহলের একাংশ!
আদালতে ওই আইনজীবী তাঁর মক্কেলের হয়ে ওইদিন দাবি করেন, রাজস্থানে থাকাকালীন মুকেশ গ্রেফতার হয়। ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয় রাজস্থান থেকে। আর দিল্লির ঘটনাটি ঘটে, ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। যদিও, এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করেন সরকারি আইনজীবী। এমনই জানা যায়, সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে।
প্রসঙ্গত, চার আসামির তিনজন অক্ষয় ঠাকুর, পবন গুপ্তা এবং মুখেশ সিং, নিজেদের ফাঁসি স্থগিতের জন্য আগেও আবেদন করেন দিল্লির পাতিয়ালা আদালতে। সেই আবেদনই ৩ মার্চের ফাঁসির তারিখের আগে খারিজ করে আদালত। এদিকে আরেক আসামি পবন গুপ্তার করা, কিউরেটিভ পিটিশনও খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট। যার ফলে, প্রথমত ৩ মার্চের ফাঁসির ক্ষেত্রে তেমন কোনও বাধা থাকে না। কিন্তু সবকিছু ঠিক থাকলে, ওই তারিখেই তিহার জেলে ফাঁসি হতে পারত ওই চারজনের। তবে জানা যায়, রাষ্ট্রপতির কাছে রয়েএক অপরাধীর প্রাণভিক্ষার আবেদন। সেই আবেদন সম্প্রতি নাকচও করেন রাষ্ট্রপতি।
যদিও, এই ফাঁসির তারিখ বারবার পিছিয়ে যাওয়ার পর, স্বভাবতই অখুশি হয় নির্ভয়ার পরিবার। নির্ভয়ার মা আশাদেবী আগেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন বিচারপর্ব ও শাস্তির এই দেরি নিয়ে। কিন্তু পরে আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০ মার্চ, ফাঁসির দিনধার্য করা হয়।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর, চিকিৎসাশাস্ত্রে পাঠরত ছাত্রী, তাঁর বন্ধুর সঙ্গে ফিরছিলেন। দিল্লিতেই চলন্ত বাসে নৃশংস ঘটনার কবলে পড়েন তিনি। তাঁর উপর অকথ্য অত্যাচারের ফলে, কিছুদিন পর, ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় ২৩ বছরের ওই নির্যাতিতার। এই ঘটনার পর, উত্তাল হয় গোটা দেশ। আইন সংশোধনে বাধ্য হয় সরকার। তারপর বদলে যায় সাবালকত্বের সংজ্ঞা। গ্রেফতার হয় ৬ অভিযুক্ত। দ্রুত বিচার শুরু হয়। একজন নাবালক হিসেবে গণ্য হয়ে ছাড়া পায়। রাম সিং নামে, আরেকজন জেলেই আত্মহত্যা করে। বাকি থাকা চারজনের বিচার চলতে থাকে। কিন্তু তা নিয়েও দেরির অভিযোগ ওঠে বারবার। বন্দিরা বারবার আবেদন করতে থাকে আদালতে, আবার কখনও রাষ্ট্রপতির কাছে। কিন্তু এক এক করে বারবার খারিজ করা হয় সব আবেদন। অবশেষে মৃত্যু-পরোয়ানা জারি করে আদালত। ২০২০-র ২২ জানুয়ারি, ফাঁসির দিন ধার্য হলেও তা পিছিয়ে যায়। ফের দিন ধার্য হয় ১ মার্চ। আবার পিছিয়ে যায় দিন। তারপর, ৩ মার্চ ধার্য করা হয়। কিন্তু তাতেও বাঁধে আবেদনের গেরো। এবার সেই অপেক্ষার অবসান হল আজ।
২০.০৩.২০২০
নয়াদিল্লি